খুবই হতাশ হয়েছি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শুধু তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নয়, সারা দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা আগ্রহ ও আশার সঞ্চার হয়েছিল। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যেসব প্রশ্ন ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল, সবাই আশা করেছিল ডাকসু নির্বাচন এর জবাব দেবে। অর্থাৎ উল্টোটা করে দেখাবে।

বাস্তবে দেখা গেল ডাকসু নির্বাচন শেষ পর্যন্ত শুধু ছাত্রলীগ ছাড়া সবাই প্রত্যাখ্যান করল। এটি খুবই হতাশার বিষয়।

যখন ডাকসু নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়, দেশের সব কটি রাজনৈতিক দল এ রকম একটা আশা প্রকাশ করেছিল যে এই নির্বাচন ভবিষ্যতের রাজনীতিবিদদের তৈরি হওয়ার একটা সুযোগ করে দেবে। কয়েক যুগ ধরে কোনো পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে কোনো নির্বাচন হয়নি। আর নতুনগুলো তো নয়ই। আমি অনেককে বলতে শুনেছি যে তৃণমূল থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরির সুযোগটা আমরা এভাবে হারিয়েছি। বর্তমান সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য আমরা দেখতে পাই। এই শূন্যতা তৈরি হয়েছে ছাত্র সংসদের নির্বাচন না হওয়ায়। তরুণেরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আসছেন না। কাজেই ব্যবসায়ী ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা সেই শূন্যতা ভরাট করছেন। এটা কাঙ্ক্ষিত ছিল না। কিন্তু হয়ে গেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক আমাকে বলেছিলেন, যদি ৩৫ / ৪০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ থাকে এবং নিয়মিত নির্বাচন হয়, তখন কত মেধাবী রাজনৈতিক আমরা ভবিষ্যতে পাব! কিন্তু ডাকসু নির্বাচন যা করেছে, তা এই প্রত্যাশার বিপরীতে গেছে।

যখন এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা এবং কর্মপদ্ধতি ঠিক করা হয়, তখন থেকেই শুধু ছাত্রলীগ ছাড়া বাকি সবাই তাতে পরিবর্তন আনার দাবি করেছে। একটি দাবি ছিল ভোট প্রক্রিয়াকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য ভোটকেন্দ্র হলগুলোর বাইরে একাডেমিক ভবনে স্থাপন করা। কারণ, হলগুলোতে ছাত্রলীগের একাধিপত্য। আমি একজন শিক্ষক হিসেবে জানি, হলগুলোতে ভিন্নমতের শিক্ষার্থীদের জন্য পরিসরটা খুব সংকুচিত। গণরুম আর গেস্টরুম সংস্কৃতির কথাও আমরা জানি। ফলে দাবিটি ন্যায্য ছিল। অথচ এই দাবি মানা হলো না।

আজকে গণমাধ্যমে এসেছে যে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে ভোট দিতে হলে প্রবেশ করতে পারছেন না। বিশেষ করে যাঁরা ভিন্ন মতের অনুসারী। কয়েকজন তো ভোট দিতেই পারেননি। আর ব্যালট বাক্স নিয়ে যা হলো—আগে থেকেই ব্যালট ভর্তি বস্তা পাওয়া গেল। এই গুরুতর অনিয়মের ঘটনায় একজন প্রভোস্টকে অপসারণ করার ঘটনাও ঘটল।

কিছুদিন আগে বিএনপি–জামায়াতপন্থী সাদা দলের শিক্ষকেরা সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করলেন যে নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট কোনো কাজে বা কমিটিতে তাদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। বিএনপি–জামায়াত আমলেও আওয়ামী লীগপন্থী কোনো শিক্ষককে হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব দেওয়া হতো না। কিন্তু একটি পুরোনো অনিয়ম কেন সব সময় অনিয়ম হয়ে থাকবে? যদি সাদা দলের শিক্ষকদের কমিটিগুলোতে রাখা হতো, তাহলে অভিযোগটা এত তীব্র হতো না।

আমাদের চোখে ধরা পড়ল যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেক প্রার্থী জয়ী হলেন। এটা রাজনীতির চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে এটি হওয়া উচিতই নয়। তাহলে প্রশ্ন আসবে, আমরা কোন মডেলের নির্বাচন ভবিষ্যতের জন্য উপহার দিচ্ছি। তা ছাড়া নির্বাচনের আগেই যে ব্যালট বাক্স ভর্তি হলো। হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলবে, মাত্র দু–এক জায়গায় এ রকম হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনটা হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের, যাঁরা জাতিকে ভবিষ্যতে পথ দেখাবেন। এটি কি পথ দেখাবার উপায় হলো?

আমি আশা করেছিলাম ডাকসু নির্বাচন হবে স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও অভিযোগবিহীন। তা হয়নি। এমনকি ব্যালট বাক্সও স্বচ্ছ রাখা হয়নি। কেন তাহলে অনেক প্রশ্ন রেখে নির্বাচন হবে? আমি আরও আশা করেছিলাম, ডাকসু নির্বাচন চাকসু, রাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে নির্বাচনের জন্য আদর্শ হবে। এখন আমাকে তাকিয়ে থাকতে হবে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে, যারা হয়তো একটা আদর্শ নির্বাচন করবে। কিন্তু সে সম্ভাবনাটাও এখন সুদূরপরাহত।

তবে নির্বাচনের একটি ভালো দিক আমার চোখে পড়েছে। এতে কোনো রক্তপাত হয়নি। আপাতত এই ইতিবাচক দিক থেকে আমরা আবার যাত্রা শুরু করতে পারি।

এই ডাকসু নির্বাচন আমাদের শিক্ষক রাজনীতির অন্ধকার একটি দিক তুলে ধরল। একজন শিক্ষকের কাছে সব শিক্ষার্থীই সমান। তাঁর দলীয় পরিচয় যা–ই হোক না কেন। এই নির্বাচনে শিক্ষকেরা সেটি দেখাতে ব্যর্থ হলেন। এর ফলে তাঁদের ওপর শিক্ষার্থীদের আস্থা কমবে। শিক্ষক হিসেবে আমাদের সামাজিক মর্যাদা একটুখানি হলেও হারাব।

শিক্ষাবিদ ও লেখক