অর্থ মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতির ৩৩ উৎস

>

• পেনশনের টাকা আটকে রাখা
• ভুয়া ভ্রমণ ভাতা ও বিনোদন ভাতার বিল পরিশোধের মাধ্যমে
• উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ ছাড়েও হয় দুর্নীতি
• সার্ভিস বুক ভেরিফিকেশন, এরিয়ার বিল দাখিলের পর এবং পে-ফিক্সেশনের বেলায় অনিয়মিতভাবে টাকা নেওয়া হয়

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন দেশের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়গুলো সরকারি কর্মচারীদের কাছ থেকে অনিয়মিতভাবে অর্থ নিয়ে থাকে। পেনশনের টাকা আটকে রেখেও কার্যালয়গুলোতে দুর্নীতি করা হয়। আবার ভুয়া ভ্রমণ ভাতা ও বিনোদন ভাতার বিল পরিশোধের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেন কার্যালয়গুলোর একশ্রেণির কর্মচারী। উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ ছাড়েও দুর্নীতি করেন তাঁরা। হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়গুলোতে দুর্নীতির এ রকম ৩৩টি সম্ভাব্য উৎস চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব দুর্নীতি দূর করতে ২১টি সুপারিশও করেছে সংস্থাটি।

হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে গঠিত দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক দলের একটি অনুসন্ধানী ও পর্যবেক্ষণমূলক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। দুদক কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক খান গতকাল সোমবার শেরেবাংলা নগরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কার্যালয়ে এ প্রতিবেদন জমা দেন। দুদক ২০১৭ সালে ২৫টি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে যে ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক দল গঠন করেছিল, এটি তারই একটি।

দুদক কমিশনারের প্রতিবেদন পাওয়ার পরপরই গতকাল অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন তিনি রাষ্ট্রীয় সব কাজে দুর্নীতি বরদাশত করবেন না, দুর্নীতিকে গ্রহণ করবেন না এবং দুর্নীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করবেন না। এই ছিল জাতির কাছে তাঁর প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করেই জাতি আমাদের ভোট দিয়েছে এবং আমরা ক্ষমতায় এসেছি।’

অর্থমন্ত্রী বলেন, তিনি চান তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা যেমন দুর্নীতি করবেন না; তাঁদের নিচে যাঁরা আছেন, তাঁরাও দুর্নীতি করবেন না। এমনকি যিনি চা বানান, যিনি ফাইল নিয়ে যান, তিনিও যেন কোনো অবস্থায় দুর্নীতির মাধ্যমে লাভবান না হতে পারেন।

দুদক কমিশনারের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা ভালো জায়গায় এসেছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেই সবাই সংশ্লিষ্ট। আর দুর্নীতির সঙ্গে অর্থের সংশ্লেষ থাকে। দুর্নীতি মানেই হচ্ছে অর্থ। আমাদের ধর্ম দুর্নীতি কখনো গ্রহণ করে না।’

অল্প কয়েক দিন হলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে এসেছেন জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘তিনি (দুদক কমিশনার) আমার কাছে এসেছেন, আমি যেন দুর্নীতির বিষয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারি। তিনি একজন পেশকার, আমিও একজন পেশকার। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারকে সহায়তা করা।’

দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দুদক বিশ্বাস করে সংস্থাটির সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য এবং সরকারি পরিষেবায় ঘুষ, দুর্নীতি, হয়রানি ও দীর্ঘসূত্রতা কমানো সম্ভব।

দুর্নীতির উৎস ও সুপারিশ
ভুয়া ভ্রমণ ভাতা, শ্রান্তি বিনোদন ভাতার বিল পরিশোধ করে সরকারি অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি হিসাবরক্ষণ কার্যালয়গুলো আরও যেসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি করে সেগুলো হচ্ছে সরকারি কর্মচারীর নতুন কর্মস্থলে যোগদান করার পর হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ের একশ্রেণির কর্মচারী শেষ বেতনপত্র নতুন কর্মস্থলে পাঠাতে এবং অবসরে যাওয়ার পরও তা পাঠাতে দেরি করেন; হয়রানি ছাড়া সার্ভিস বিবৃতি না দেওয়া; সার্ভিস বুক ভেরিফিকেশন, এরিয়ার বিল দাখিলের পর এবং পে-ফিক্সেশনের বেলায় অনিয়মিতভাবে টাকা নেওয়া; ভবিষ্য তহবিল (জিপিএফ) হিসাব খোলা, জিপিএফের অগ্রিম অর্থ উত্তোলনের সময় এবং জিপিএফ হিসাব থেকে চূড়ান্ত অর্থ পরিশোধের বেলায় অনিয়মিতভাবে টাকা আদায়; সরকারি বিভিন্ন অগ্রিম যেমন গৃহনির্মাণ, গাড়ি, মোটরসাইকেল, কম্পিউটার ইত্যাদি বিল দেওয়ার সময় অনিয়মিত আর্থিক সুবিধা আদায়; সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ কর্মচারীদের আনুতোষিক (গ্র্যাচুইটি) দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়মিত অর্থ আদায় ইত্যাদি।

দুর্নীতির উৎস বন্ধে দুদক দল ২১টি সুপারিশ করেছে। যেমন, কার্যালয়গুলোতে জনবল বৃদ্ধি ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতায় আনা; সব ধরনের বিল ইলেকট্রনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, অভিযোগ ব্যবস্থাপনাপদ্ধতি সহজ করা এবং ভুক্তভোগীদের অভিযোগ দাখিল, শুনানি ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা রাখা; দাপ্তরিক কাজে গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা আনতে কর্মচারীদের প্রতি তিন বছর পর বদলির বিষয়টি শক্তভাবে অনুসরণ করা; ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে পেনশন কেস নিষ্পত্তি করা; উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় মাঠপর্যায়ের কার্যালয়গুলোতে নিয়মিত পরিদর্শন করা; বেতন-ভাতাসহ সব ধরনের বিল পরিশোধের বেলায় দায়িত্ব অবহেলা এবং দেরির জন্য দায়ী কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা; সিজিএ কার্যালয়ে ‘হটলাইন’ স্থাপন করা এবং হটলাইনের মাধ্যমে পাওয়া অভিযোগ নিয়মিত পর্যালোচনা করা ইত্যাদি।