সবই দিয়ে তাঁরা আজ সর্বহারা

মুক্তিযুদ্ধ আমি দেখিনি। তবু সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে যুদ্ধের স্মৃতি ভেসে থাকে। মনের ভেতর নাড়াচাড়া করতে থাকে শুধু ১৯৭১ সালের সেই মা-বোনদের ভয়াবহ করুণ ঘটনার কথা। ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অগণিত মা-বোনের ছবি, যাঁরা বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় বিশাল একটা অংশ জুড়ে রয়েছেন। যাঁরা বাংলাদেশে আছেন, তাঁদের সম্পর্কে আমরা কম-বেশি মোটামুটি কিছু জানি। আর যাঁরা দেশের বাইরে আছেন, তাঁরা কোথায় কী অবস্থায় আছেন, তাঁদের খোঁজখবরই বা কজন জানি? এমন দুজনের কথা এখানে তুলে ধরা হলো।

প্রথমে বলি আফরোজা বেগমের কথা। ১৯৭১ সালে আফরোজা ছিলেন স্বপ্না রানী। তাঁর বয়স আর কত? ১৮ কি ১৯। বাড়ি বগুড়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় মে-জুনে তিনি ধরা পড়েন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। এর পাঁচ-ছয় মাস আগে তাঁর বিয়ে হয়েছে। তাঁকে ক্যাম্পে রেখে দিন-রাত ধর্ষণ করত পাকিস্তানি সেনারা। দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে উদ্ধার করেন। শ্বশুর বা বাবার বাড়ি—কোথাও তাঁর ঠাঁই হয়নি। তখন তিনি ঢাকায় আশ্রয়কেন্দ্রে এসে ওঠেন। তাঁর কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে একটি ছেলে। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা-যাওয়া করতেন তারেক নামের এক মুক্তিযোদ্ধা। তারেক তাঁর অসহায় অবস্থা দেখে বিয়ে করেন। কিন্তু তারেক আফরোজাকে আর ঘরে তুলতে পারেননি। তারেকের আগের স্ত্রী ছিলেন এবং বড় বড় ছেলেমেয়েও ছিল। একসময় আফরোজা বাচ্চা নিয়ে অসহায়ের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকেন। একসময় আলমগীর নামের একজনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। আলমগীর তাঁকে বাড়ির কাজ করার জন্য প্রস্তাব দেন। আফরোজা রাজি হন, ঠাঁই মেলে আলমগীরের বাড়িতে।

কয়েক মাস যেতে না যেতে ঠিকানা আবার সেই রাস্তা। ঘুরতে ঘুরতে আবার দেখা মেলে প্রথম স্বামীর এক আত্মীয়ের সঙ্গে। তিনি তাঁকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। আফরোজা চলে যান ভারতে। সেখানে তিন-চার বছর বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন। তবে তেমন সুবিধা করতে পারেননি। শেষমেশ তাঁর আশ্রয় হয় যৌনপল্লিতে। তাঁর কাছে এমন একজন নিয়মিত যেতেন, যিনি তাঁকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেন। অনেক ভেবেচিন্তে ছেলের দিকে তাকিয়ে রাজি হন। প্রথম প্রথম ওই লোক একাই তাঁকে ব্যবহার করতেন। ধীরে ধীরে তাঁর কাছে আরও অনেকে আসতে শুরু করেন। আফরোজার বয়স বাড়তে থাকে। শরীর আগের মতো ধকল নিতে পারে না। এদিকে ছেলেও বড় হয়ে উঠছে। এ নিয়ে সেই লোকের সঙ্গে প্রায়ই তাঁর খিটিমিটি লাগে। একবার বড় ধরনের ঝগড়া হলে লোকটি তাঁকে বিদেশে ফেলে দেশে চলে আসেন। আফরোজার পাসপোর্টটাও তিনি নিয়ে আসেন। তাঁর ঠাঁই হয় জেলখানায়। বেশ কয়েক বছর জেলখানায় থাকার পর আফরোজা ছাড়া পান। কিন্তু তত দিনে তিনি সব হারিয়ে ফেলেন। তাঁর ছেলের আর কোনো সন্ধান পাননি এবং ভারতে যে আসবেন, সে পথও তাঁর নেই। ছেলের তো কোনো ঠিকানা ছিল না, এখানে-সেখানে থাকতেন, ছিল না কোনো পরিচয়। আর তাঁর ছেলেও জানেন না যে তাঁর মা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কোন দেশে গেছেন, কবে ফিরবেন। তা ছাড়া আফরোজার পাসপোর্ট না থাকায় তিনি আর বাংলাদেশ কিংবা ভারত কোথাও আসতে পারেননি। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁর দেশের সন্ধান করতে পারেননি। বয়সের ভারে এখন তিনি বড় বেশি ক্লান্ত। এখন আর কারও কথা চিন্তা করার মতো অবস্থা তাঁর নেই। নিজেই অনেক কঠিন জীবন যাপন করছেন। নিজে কাজকর্ম করতে পারেন না। বলতে গেলে অনাহারে-অর্ধাহারে কাটছে জীবন। মানুষের কাছে হাত পেতে যা পান, তা-ই খান।

আফরোজা অনেক কিছু ভুলে গেছেন। তাঁর ভাষ্য, জেলখানায় তাঁর ওপর অনেক অত্যাচার করা হয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের ভাষা বুঝতাম না আর তারাও আমার ভাষা বুঝত না। যারা আমাকে নির্যাতন করত, তারা ভাবত যে আমি সব বুঝি কিন্তু তাদের কথার উত্তর দিচ্ছি না। তাই ভুল-বোঝাবুঝির জন্য বেশি অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে।’

আমার সঙ্গে আফরোজার কথা হয় ২০১৫ সালের মাঝামাঝি। তিনি বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলেন। বাংলায় কমই বলেন। প্রথমে কথা বলতে রাজি হননি। কারণ, তিনি বেশ অসুস্থ। শারীরিক ও মানসিক দুভাবেই। আফরোজা থাকেন আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গ এক পরিবারের সঙ্গে (এখানে স্থানটি গোপন রাখা হলো)। শ্বেতাঙ্গ পরিবার তাঁকে থাকতে দিচ্ছে বাড়ির একটি ভাঙা পরিত্যক্ত ঘরে—এটুকুই। তাঁর খাবার, পোশাক, চিকিৎসার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়। যেখানে থাকেন, সেখান থেকে কিছু দূরে একটি শপিং মলের ভেতরে একটি খাবারের দোকানে তিনি কাজ করছিলেন। শরীরটা যখন ভালো থাকত, তখন ঘণ্টা হিসাবে কাজ করতেন। কাজ করতে না পারলে খাবার জুটত না। ভিক্ষাই ছিল অবলম্বন। এভাবেই কেটে গেছে আট-নয় বছর। এখন তিনি অচল, চলাফেরা করতে পারেন না। যে বাড়িতে তাঁকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, সে বাড়ির গাড়িচালক তাঁকে সকালে একটা জায়গায় রেখে আসেন। পরে আবার নিয়ে আসেন। এভাবেই কাটছে তাঁর দিন।

আফরোজার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি বাংলাদেশে আসতে চান কি না? তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমাদের ইজ্জতের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আর সেই দেশে আমার আশ্রয় হলো না, সেই দেশে কেন আর ফিরে যাব?’ তিনি বলেন, ‘একসময় সেই দেশে আমার মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, আপনজন ছিল। এখন হয়তোবা আর কেউ বেঁচে নেই, কার কাছে যাব? আমার ঠিকানা ছিল, ঘরবাড়ি, ভিটা ছিল। যে ভিটাতে আমার জন্ম হলো, সেই ভিটাতেই আমার জায়গা হলো না। কিন্তু আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল, ভালোবাসা ছিল। আজ তো আর কিছুই নেই। এখন আমি মৃত্যুর প্রহর গুনছি। এখন আমার শুধু একটাই চাওয়া—মৃত্যুর আগে যদি একবার, শুধু একবার আমার সন্তান এসে আমাকে মা বলে ডাকত। এটাই শুধু চাওয়া। জানি, এটাও কোনো দিন কোনো অবস্থায় সম্ভব নয়। আমার মতো তারও তো কোনো পরিচয়-ঠিকানা নেই। কেমন করে আমি তাকে পাব?’

এবার আরেক মায়ের কাহিনি। ১৯৭১ সালে মালেকার বয়স ছিল ১৪-১৫ বছর। বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। এমন সময় দেশে যুদ্ধ লেগে যায়। বিয়ের কথাবার্তা থেমে যায়। যুদ্ধ শুরুর দিকের কথা। একদিন হঠাৎ করে একদল পাকিস্তানি সেনা গ্রামে হামলা চালায়। মালেকা বাড়িতে ছিলেন না বলে বেঁচে গিয়েছিলেন। মাঠে ছাগল নিয়ে গিয়েছিলেন। দূর থেকে পাকিস্তানি বাহিনী দেখতে পেয়ে মালেকা তাড়াতাড়ি দৌড়ে মাঠের পাশের পাহাড়ের পেছনে জঙ্গলের ভেতরে গিয়ে পালিয়ে থাকেন।

এর দু-তিন দিন পর আবার গ্রামে পাকিস্তানি সেনারা হামলে পড়ে। সেদিন মালেকা আর টের পাননি, ধরা পড়েন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। নিজ বাড়িতে নিজের ঘরে ধর্ষণের শিকার হন মালেকা। কয়েকজন মিলে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় তাদের ক্যাম্পে। সেই ক্যাম্পে আরও বহু নারী ছিলেন। অনেকেই ক্যাম্প থেকে পালাতে অনেক রকম চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কেউ পালাতে পারেননি। কারণ, ক্যাম্পের চারপাশে ছিল নদী, পানি আর পানি। পাকিস্তানি বাহিনী সেই ক্যাম্পে আসা-যাওয়া করত। জোয়ারের সময় বড় বড় জাহাজে করে আসা-যাওয়া করত। গ্রাম থেকে আসার সময় জাহাজ ভর্তি করে মালামাল যেমন চাল-ডাল, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, তেল, লবণ লুট করে নিয়ে আসত। সঙ্গে থাকত মানুষ। নারীদের ধরে এনে তাদের ইচ্ছেমতো অত্যাচার-নির্যাতন চালাত। প্রায়ই নারীদের জাহাজে করে মাঝনদীতে নিয়ে গুলি করে ফেলে দিত। পুরুষদের ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করত। জিজ্ঞাসা করার সময় অনেক অত্যাচার করত, যা সহ্য করা বা বর্ণনা দেওয়ার মতোও নয়। তাঁদের গুলি করে লাশ ফেলে দিত নদীতে। সেই ক্যাম্প থেকে হালিমা, বেলা আর নাম না জানা দুজন পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পালাতে পারেননি। তাঁদের প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। সেই শাস্তি দেখে আর কারও পালাবার সাহস হয়নি। সেই শাস্তির কিছুটা বর্ণনা দিয়েছেন মালেকা। বর্ণনা দিতে গিয়ে মালেকা বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। ‘পাকিস্তানি বাহিনীদের অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কয়েকজন মেয়ে পালানোর জন্য একদিন খুব ভোরে ক্যাম্প থেকে বের হন। কিন্তু তাঁরা ধরা পড়ে যান। তাঁদের ধরে এনে নগ্ন করে সারা শরীর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেচে লবণ-মরিচ মেখে ফেলে রাখে। এই অবস্থায় একটু পরপর একজন-দুজন করে এসে তাঁদের ওপর অত্যাচার চালায়। বিকেলের দিকে তাঁদের গোপনাঙ্গে সেদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দেয়। তখন তাঁদের চিৎকারে মনে হতো আকাশ বাতাস থমকে গিয়েছিল। তাঁদের চিৎকারে আসমান-জমিন কেঁপে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সারা রাত ওখানেই পড়ে রইলেন তাঁরা। সকালে আবার সেই মরিচ বাটার সঙ্গে লবণ মিশিয়ে তাঁদের সারা শরীরে মাখিয়ে দিয়েছে। এভাবে তাঁদের কষ্ট দিয়ে কয়েক দিন পর নদীতে ফেলে দিয়েছে।’

মালেকা বলেন, ‘আমার এক চাচাতো ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর বয়স ২২-২৪ বছর হবে, নাম মালেক। তাঁর ছোট ভাই যুদ্ধে গিয়েছেন। তাঁর সন্ধান না পেয়ে তাঁকে ধরে আনে। মালেক বাক্প্রতিবন্ধী ছিলেন। আর বাক্প্রতিবন্ধীরা তো কানেও শোনে না। তাই পাকিস্তানি সেনাদের কথা শুনতে পেত না। তাদের কথার উত্তরও দিতে পারত না। তাই তাঁকে একটু বেশি অত্যাচার করত। মালেকের ওপর অত্যাচার দেখে সহ্য করার মতো অবস্থা ছিল না। মালেককে অনেকক্ষণ ধরে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করছিল। কিন্তু মালেক তাদের কথার উত্তর না দেওয়ায় তাঁকে অত্যাচার করে। প্রথমে তাঁর দুই হাত কেটে ফেলে কবজি থেকে। তারপর তাঁর পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে, সারা শরীর সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে পুড়িয়ে দেয়, লবণ ছিটিয়ে দেয়। তারপর রড গরম করে...। সে কথা বলে না বলেই তাঁর এসব শাস্তি। তারা তো জানে না যে সে কথা বলতে পারে না, কানেও শোনে না। তারপর তাঁর জিহ্বা কেটে ফেলে। ও মা গো। জিহ্বাটা টেনে ভেতর থেকে মনে হয় আধা হাত বাহির করে এনে কেটে তারা কত উল্লাস করেছে। এ কী অবস্থা! না দেখলে এ অবস্থা বলে বোঝাতে পারব না। এটি দেখে আমি তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। পরে শুনেছি তাঁকে নদীতে ফেলে দিয়েছে।’

মালেকা বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার মাসখানেক আগে আমাকে নদীতে ফেলে দেয়। ওরা হয়তো ভেবেছিল যে আমি মরে গেছি, তাই ফেলে দিয়েছে। ভাসতে ভাসতে আমি সেন্ট মার্টিনের কাছে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। মাছ ধরতে গিয়ে জেলেরা আমাকে উদ্ধার করে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যান। একটা বাড়িতে আমাকে রাখেন। তাঁরা আমাকে ওষুধ দিয়ে ও সেবাযত্ন দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। জেলেরা নিজেরাই বনজঙ্গল থেকে বনজ ওষুধ দিয়েছেন।’

মালেকা বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হলে বাড়িতে ফিরে এসে দেখি, সব ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শুধু ফাঁকা ভিটাটা পড়ে আছে। আশপাশের বেশ কিছু ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কয়েকজনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আমার মা-বাবা কিংবা বাড়ির লোকজন কোথায় আছেন, তা তাঁরা জানেন কি না। তাঁরা আমার সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা, কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এলাকা থেকে বের করে দিয়েছেন। তারপর অনেক আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলেননি। আমি মানুষ হয়েও কুকুরের মতো এখানে-সেখানে, এবাড়ি-সেবাড়ি গিয়ে আশ্রয় চেয়েছি। এক বেলা খাবার খেতে চেয়েছিলাম। খাবার দেবে তো পরের কথা, এক গ্লাস পানিও দেয়নি। এরই মধ্যে টের পেতে আর বাকি রইল না যে আমার শরীরের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। আরও চিন্তায় পড়ে গেলাম। এত দিনের এত নির্যাতন, তার ওপর আবার নতুন একটা সমস্যা। মন-শরীর কোনো কিছুকেই মানাতে পারছি না। তখন আমি দিশেহারা। দিনরাত এবাড়ি-ওবাড়ি গিয়েও কোনো আশ্রয় মেলাতে পারিনি। একদিন একটি বাড়ির রান্নাঘরের পেছনে শুয়ে ছিলাম। খুব সকালে শুনি লোকজনের কথা। বুঝতে পারি, তারা কোথাও যাচ্ছে। আমি উঠে বসি। কিছু বলার সাহস নেই। কিন্তু আমার সম্পর্কে তাদের বুঝতে আর বাকি রইল না। তাদের মধ্য থেকে একজন আমাকে বললেন, “আমরা ভারত যাচ্ছি, তুমি যাবে?” চলে গেলাম তাদের সঙ্গে। দেশ ছেড়েও ঘর, বর, সংসার—কিছুই পাইনি। পেয়েছি একটি সন্তান, যার কোনো পরিচয় নেই।

‘আমি মা হয়ে আজও জানতে পারিনি আমার এ সন্তানের বাবা কে, কী তার পরিচয়? পৃথিবীতে যখন একটা সন্তান আসে, তখন বাড়ির লোকদের মধ্যে কত আনন্দ-উল্লাস থাকে, কত প্রতীক্ষায় থাকে বাড়ির লোকজন, কত কান্নাকাটি করে বাড়ির মুরব্বিরা—ছেলে হবে না মেয়ে হবে, কত কী হয়। আর আমার সন্তান পৃথিবীতে এল ঠিকই, কালো অন্ধকার হয়ে। কোনো দিন আলোতে যেতে পারিনি। কখনো মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারিনি। যখন মেয়ের বয়স ১৫-১৬ বছর, তখন সে তার সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। আমি কিছুই বলিনি। কিন্তু একসময় যখন সে সবকিছু জানতে পারে, তখন সে গলায় দড়ি দেয়। আজ আমি একা, শুধুই একা। মেয়েটা বেঁচে থাকলে আজ হয়তোবা এত একা থাকতাম না।’