'গ্লাডিওলাস' হতে পারে চাষির ঘরে নতুন ফসল

খেতে ফুটে আছে ‘গ্লাডিওলাস’ ফুল। সম্প্রতি মৌলভীবাজারের আকবরপুর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে।  ছবি: প্রথম আলো
খেতে ফুটে আছে ‘গ্লাডিওলাস’ ফুল। সম্প্রতি মৌলভীবাজারের আকবরপুর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে। ছবি: প্রথম আলো

সারা বছর তো কিছু জমি পতিত থাকেই। এই জমিতে কোনো ফসলেরই চাষ হয় না। আবার আমন ধান কাটার পর এই পতিত জমির পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। কিছু জমিতে প্রচলিত কিছু সবজি ও শস্য চাষ হয়তো হয়। কিন্তু অনেক জমিই পড়ে থাকে খালি। এই পতিত জমিতে ‘গ্লাডিওলাস’ হতে পারে চাষির ঘরে নতুন এক ফসল। উপার্জনের নতুন এক উপায়।

আর এই সম্ভাবনা শুধু মৌলভীবাজার জেলার জন্যই অপেক্ষা করছে না, বৃহত্তর সিলেটজুড়েই খুলে দিতে পারে চেনা চাষবাসের বাইরে ফুল চাষের নতুন এক বাণিজ্যিক দিগন্ত। মৌলভীবাজারের আকবরপুর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে গেলে দূর থেকেই চোখে পড়ে ঢেউখেলানো ছোপ ছোপ রঙের সারি। প্রকৃতির কোলে চারপাশের সবুজে ঘেরা টিলার ফাঁকে রংধনুর মতো এক সারি রং যেন আপন মনে ফুটে আছে। লাল, সাদা, বেগুনি নানা রঙের মেলা। কাছে ভিড়লে সে রং আরও উজ্জ্বল, আরও নজরকাড়া। এই রং আসলে গ্লাডিওলাস ফুলের। নতুন মাটিতে পরীক্ষামূলক চাষের সফল প্রকাশ।

আকবরপুর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বর্তমানে ২০৮টি ফসল নিয়ে গবেষণা করছে। এই গবেষণার মধ্যে আছে ফল, সবজি ও ফুল। দেশে যশোর জেলায় প্রথম ফুলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরু হয়। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বেশি ফুলের উৎপাদনও হচ্ছে যশোরে। আরও কয়েকটি জেলায় ফুলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ফুল চাষে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল এখনো পিছিয়ে। এখনো বাণিজ্যিক ফুলের চাষবাস এই অঞ্চলে দেখা যায় না। অনেকের ধারণা, এই অঞ্চলের মাটিতে উচ্চ মাত্রার লবণাক্ততা রয়েছে। এ মাটিতে ফুল চাষ করা যাবে না। সে জন্য কোনো চাষি বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষে আগ্রহী নন। এতে ১২ মাসই বৃহত্তর সিলেটের প্রচুর জমি পতিত পড়ে থাকছে। আমন ধান কাটার পর এই পতিত জমির পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। কিছু জমিতে প্রচলিত মৌসুমি সবজির চাষ হয়। বাকি জমিতে কোনো জাতের ফসলই কেউ চাষ করে না।

এই পতিত জমিকে চাষের কাজে লাগানোর চিন্তা থেকে আকবরপুর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম শরিফুজ্জামানের নেতৃত্বে একদল গবেষক আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে গ্লাডিওলাস ও টিউব রজনীগন্ধা ফুলের চাষ করেন। চাষে তাঁরা সফলতাও পেয়ে যান। ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় গ্লাডিওলাসের খেত। ১২ রঙের গ্লাডিওলাস ফুটেছে তাঁদের চাষের খেতে। সাদা, লাল, হলুদ, পিঙ্ক, বেগুনিসহ বহুরঙা এই ফুলগুলো নজরকাড়া রূপে উজ্জ্বল। গ্লাডিওলাস মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার ফুল। কিন্তু ফুলটির মন আমোদ করা রূপ দেশের বাজারে তার চাহিদা তৈরি করে নিয়েছে। বর্তমানে মৌলভীবাজারে বিয়ে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সাজসজ্জা এবং জাতীয় দিবসে ফুলের চাহিদা পূরণ হচ্ছে যশোর ও ঢাকা থেকে আসা ফুলে। অনেক দূরের উৎপাদনস্থান থেকে আসা এই ফুল পরিবহনের সময় অনেকটা নষ্ট হয়ে যায়। অনেক ফুলের সৌন্দর্য আর ঠিক থাকে না। ফলে এই জেলায় ফুলের দামও অনেক বেশি পড়ে।

আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকেরা জানিয়েছেন, আকবরপুরে গ্লাডিওলাস ও টিউব রজনীগন্ধার সফল চাষ থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, সিলেট অঞ্চলে ফুলের বাণিজ্যিক চাষ সম্ভব। চাষিরা এগিয়ে এলে এই অঞ্চলের অনাবাদি জমি ফুলে ফুলে ভরে উঠবে। শুধু ধান বা মৌসুমি সবজির ওপর নির্ভর না করে ফুল চাষ থেকে চাষিরা লাখ লাখ টাকা আয় করতে পারবেন। এটা হতে পারে এই অঞ্চলের চাষিদের কাছে নতুন একটি ফসল। লাভও হবে ধান ও সবজি থেকে বেশি।

কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শরফ উদ্দিন ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মিরানা আক্তার জানিয়েছেন, এই ফুল চাষে তিন থেকে চার মাস সময় লাগে। আমন ধান কাটার পরই পতিত জমিতে ফুলের চাষ করা যাবে।

কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম শরিফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে এসে দেখেছি, অনেক জায়গা পতিত পড়ে থাকে। কিছু সবজি হয়। কিছু গাছ লাগিয়ে রাখা হয়েছে। ভাবলাম, এখানে ফুলের উৎপাদন হয় কি না। লাগানোর পর দেখলাম ফুল খুব ভালো হয়েছে। বৃহত্তর সিলেটে কয়েক লাখ হেক্টর আবাদযোগ্য জমি পতিত পড়ে থাকে। সব জমিতে হয়তো চাষ করা যাবে না। কিন্তু রবি মৌসুমে সমতল ভূমির যেখানে সেচের সুযোগ আছে, তা ফুল চাষের আওতায় আনা যাবে। এই অঞ্চলের মাটি কিছুটা অম্ল ধরনের হলেও তাতে গ্লাডিওলাস চাষ করা সম্ভব। এটা হয়তো গ্রীষ্মকালেও করা যাবে। আমরা সেটাও গবেষণা করে দেখব। গ্লাডিওলাস চাষে চাষিরা সবজি থেকে দ্বিগুণ লাভ পাবেন।’ তিনি জানান, সব চাষিকে হয়তো সরাসরি বীজসহ অন্যান্য সামগ্রী দেওয়া যাবে না। কিন্তু আগ্রহী চাষিকে কারিগরি ও চাষবিষয়ক সব পরামর্শ দেওয়া যাবে। ফুল চাষ এই অঞ্চলে চাষিদের সামনে আয়ের এক নতুন সম্ভাবনা বলে ওই কর্মকর্তা মনে করছেন।