মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত নিজের রাইফেল জাদুঘরে দেখতে চান তিনি

নিজের লাইসেন্স করা পয়েন্ট টু টু বোর রাইফেলটি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ছবি: প্রথম আলো
নিজের লাইসেন্স করা পয়েন্ট টু টু বোর রাইফেলটি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ছবি: প্রথম আলো

১৯৬৮ সালে ৬০০ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন পয়েন্ট টু টু বোর রাইফেলটি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর নিজের লাইসেন্স করা ওই অস্ত্র নিয়েই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এলাকার তরুণদের সংগঠিত করে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেন ওই রাইফেল দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বেশ কয়েক জায়গায় ব্যবহৃত হয় তাঁর রাইফেলটি।

মুক্তিযুদ্ধে স্থানীয় যোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে ব্যবহৃত নিজের লাইসেন্স করা পয়েন্ট টু টু বোর রাইফেলটি এখন ঢাকার কেন্দ্রীয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দেখতে চান মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম ফজলুল হক চৌধুরী, যিনি আ কা ফজলুল হক চৌধুরী নামেই এলাকায় পরিচিত। তাঁর এই ইচ্ছে পূরণের জন্য ৬ মার্চ রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত আবেদন করেছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষক হিসেবে এলাকায় ফজলুল হক চৌধুরীর স্বীকৃতি থাকলেও তাঁর নাম যুক্ত করা হয়নি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায়।

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে আ কা ফজলুল হক চৌধুরী (৮৩) রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার ছোটভাকলা ইউনিয়নের চর কাঁচরন্দ গ্রামের বাসিন্দা।

প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে মুক্তিযোদ্ধা আ কা ফজলুল হক চৌধুরী জানান, ১৯৬৪ সালে তৎকালীন গোয়ালন্দ মহকুমার সাবডিভিশন কার্যালয়ে (বর্তমানে রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক কার্যালয়) চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৯৫ সাল তিনি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখার ওয়্যারলেস অপারেটর হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নেন। ১৯৬৮ সালে খুলনা থেকে ৬০০ টাকা দিয়ে তিনি রাইফেলটি কিনেন। সরকারি চাকরি করলেও ১৯৭১ সালে তিনি অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর তিনি অনুধাবন করেন, চূড়ান্ত বিজয় ছাড়া বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পাত্র নন। ফলে যুদ্ধ অনিবার্য। এ সময় তিনি এলাকার যুবকদের বোঝাতে শুরু করেন, সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। যাঁরা তাঁর কথায় আগ্রহী হয়ে উঠলেন, তাঁদের নিয়ে ১৯৭১ সালের ১০ মার্চ গোয়ালন্দ উপজেলার তেনাপচা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে প্রথম রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। এরপর বিভিন্ন গোপন স্থানে তাঁর লাইসেন্স করা রাইফেল দিয়ে তিনি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন।

ফজলুল হক চৌধুরী জানান, তাঁকে সহযোগিতার হাত বাড়ান বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এস এ মালেকসহ কাজী হেদায়েত হোসেন। এস এ মালেকের একটি লাইসেন্স করা রাইফেল ছিল। সেটিও প্রশিক্ষণে ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। ওই সময়ে ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তাঁরা জানতে পারেন, দক্ষিণবঙ্গের প্রবেশদ্বার গোয়ালন্দ ঘাট দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ২৭ বা ২৮ মার্চ দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকবে। সেখানে স্থানীয় শত শত মানুষ ব্যাগ ভর্তি করে রেললাইনের খোয়া, দু–একটি অস্ত্রসহ দা-কাঁচি-খন্তি নিয়ে প্রতিরোধে অংশ নেয়। তবে সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে না এসে পাবনার নগরবাড়ীর দিকে ঢোকে। এরপর এস এ মালেক তাঁকে জানান, কুষ্টিয়ায় ইপিআর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরীকে সহযোগিতা করতে সেখানে যেতে হবে।
ফজলুল হক চৌধুরী বলেন, ‘সম্ভবত ৩১ মার্চ আমরা কুষ্টিয়ায় একটি যুদ্ধে অংশ নিই। সেখানে আমাদের দুজন সহযোদ্ধা শহীদ হন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী তাঁদের এক প্লাটুন ইপিআর ও বেশ কিছু রাইফেল, মেশিনগান, এলএমজি দিয়ে গোয়ালন্দে পাঠিয়ে দেন। ২১ এপ্রিল গোয়ালন্দের প্রতিরোধ যুদ্ধে এসব অস্ত্র নিয়ে ইপিআর সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন। স্থানীয় রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীকে তথ্য সরবরাহ করায় ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীকে আমরা প্রতিরোধ করতে পারিনি।’

ফজলুল হক চৌধুরী বলেন, ‘যাঁদের গায়ে আওয়ামী লীগের গন্ধ ছিল, ২৬ মার্চের পর তাঁদের আত্মগোপন ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। এরপর অক্টোবর মাসের দিকে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে আটজন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা গোয়ালন্দে ফিরে আসেন। তাঁদের প্রথমে আমার বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা করি।’

স্থানীয়ভাবে ফজলুল হক চৌধুরী একজন স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধা। জেলার একাধিক মুক্তিযোদ্ধা তাঁর সাহসিকতার কথা বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষক হিসেবে তাঁর নাম উল্লেখ করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থান পায়নি তাঁর নামটি। শুরুতে তিনি তালিকাভুক্ত হওয়ার আবেদনও করেননি। তবে পরে আবেদন করলেও তাঁকে তালিকাভুক্ত করা হয়নি।

মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা গিয়াস রচিত রাজবাড়ী জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ‘কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প’ নামের বইতে লেখক স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণে আ কা ফজলুল হক চৌধুরীর বিশেষ অবদানের কথা লিখেছেন।
এ বিষয়ে তালিকাভুক্ত দুজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ফজলুল হক চৌধুরী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মধ্যে গ্রুপিংসহ বিভিন্ন কারণে তিনি এখনো তালিকাভুক্ত হতে পারেননি।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুস সামাদ মোল্লার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘সময়মতো তিনি কেন আবেদন করেননি?’ ফজলুল হক চৌধুরী সম্পর্কে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে পারবেন না বলেও জানান।

এ প্রসঙ্গে ফজলুল হক চৌধুরী বলেন, ‘স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কারণে চাকরিতে আমি দুটি ইনক্রিমেন্ট ও দুই বছরের জ্যেষ্ঠতা পাই। আমার ধারণা ছিল, অন্যান্য বিভাগ, যেমন ইপিআর-আনসারদের মতো আমি সরকারি সিদ্ধান্তেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত হয়ে যাব। কিন্তু সেটা হয়নি। সবশেষ যাচাই-বাছাই কমিটিতে সহযোদ্ধাদের স্বীকৃতিসহ সব শর্ত পূরণ করে আমি আবেদন করি। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তা মঞ্জুর করা হয়নি।’ ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে আমি অবদান রাখতে পেরেছিলাম, মানসিকভাবে এটাই আমার বড় পাওয়া। আল্লাহর রহমতে আমার ছেলেমেয়েরা প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে তাঁদের কোনো সুবিধা আপাতত প্রয়োজন নেই। আমার কবরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে, তাই আমার ইচ্ছে, মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত রাইফেলটি যদি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়, তবে আমার পরবর্তী প্রজন্ম সেটা দেখে গর্বিত হবে।’