সাতক্ষীরার শ্যামনগরে সুপেয় পানির হাহাকার

সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার দেবালয় গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার দেবালয় গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

চারপাশে সুবিশাল জলরাশি সত্ত্বেও পানের উপযোগী একটু পানির জন্য রীতিমতো হাহাকার চলছে। খাওয়ার উপযোগী পানির অভাব পূরণে দূরদূরান্তে ছুটে বেড়ানোর পাশাপাশি অনেকে আবার পুকুরের কাদামিশ্রিত ও লবণযুক্ত পানিও পান করতে বাধ্য হচ্ছেন।
গ্রীষ্মকাল শুরুর আগেই দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সর্বত্র এমন অবস্থা বিরাজ করছে। সাম্প্রতিক বছরে এই অঞ্চলে খাওয়ার পানির জন্য বৃষ্টি-নির্ভরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও অনাবৃষ্টির কারণে সুপেয় পানির অভাব তীব্র হচ্ছে।
সরেজমিনে ঘুরে ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাকৃতিক উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়া, সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা জলাধারগুলো চাহিদা পূরণে সক্ষম না হওয়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চলমান খাওয়ার উপযোগী পানির এ সমস্যা তাঁদের দৈনন্দিন ও প্রাত্যহিক জীবনের ওপর প্রভাব ফেলছে।
শ্যামনগর সদরসহ উপকূলবর্তী গোলাখালী, কালিঞ্চি, দেবালয়, হেঞ্চিসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, খাওয়ার উপযোগী পানির জন্য মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরা পর্যন্ত পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে মাইলের পর মাইল রাস্তা পাড়ি জমাচ্ছে।
অষ্টম শ্রেণির রুখসানা পারভীন জানায়, ঈশ্বরীপুর গ্রাম থেকে চার কিলোমিটার দূরবর্তী দেবালয় গ্রামের মাজেদ সরদারের বাড়ির পুকুর থেকে দিনে দুবার পানি সংগ্রহ করতে হয় তাকে। তার মা রাশিদা বেগম বলেন, সকাল ও স্কুল ছুটির পর এত দূর থেকে দুই দফা পানি নিয়ে আসতে গিয়ে মেয়ের লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে। নিজে গৃহস্থালি ও স্বামী দিনমজুরের কাজে ব্যস্ত থাকায় মেয়েকে দিয়ে পানি টানাতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
একই পুকুর থেকে পানি সংগ্রহে আসা তিন কিলোমিটার দূরবর্তী গোমানতলী গ্রামের জাহানারা ও চুনার ব্রিজ এলাকার ফজিলা বেগম বলেন, এলাকার পুকুর পানিশূন্য হয়ে গেছে। টিউবওয়েলের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণ ও আয়রনযুক্ত। তাই বাধ্য হয়ে দেবালয় গ্রাম থেকে পানি টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এক কলসি পানির জন্য শত শত মানুষের ভিড় থাকার কারণে কখনো কখনো গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
সাবেক ইউপি সদস্য করুণা সরদার জানান, চণ্ডীপুর, সুন্দরবন তীরবর্তী গোলাখালী, হেঞ্চিসহ উপকূলীয় এই জনপদের শতাধিক গ্রামে একই অবস্থা। গ্রীষ্ম মৌসুম শুরুর আগেই এসব এলাকার প্রাকৃতিক জলাধারগুলো শুকিয়ে যাওয়া ও বর্ষা মৌসুমে সংগৃহীত বৃষ্টির পানি শেষ হওয়ায় সর্বত্রই এখন খাওয়ার পানির তীব্র সংকট। এ ছাড়া প্রতিবারের মতো এবারও বর্ষা মৌসুম শেষে উপকূলীয় জনপদে লবণাক্ততার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি পানীয় জলের সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
চণ্ডীপুর গ্রামের ইউনুস আলী এবং কাশিপুরের ইয়াছিন আরাফাত জানান, চারদিকে পানি আর পানি। কিন্তু সবটাই লবণপানি। খাওয়ার উপযোগী একটু পানির জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
কুপোট গ্রামের শিক্ষক মইনুল ইসলাম জানান, ৪০ লিটারের ড্রাম ৫০ টাকায় কিনে পানির চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। স্বরবলা মণ্ডল ও হেম মণ্ডল নামে দুর্গাবাটি গ্রামের দুই নারী জানান, তাঁদের স্বামীরা দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালান। তারপরও এলাকায় খাওয়ার উপযোগী পানি না থাকায় তাঁদেরও পানি কিনে খেতে হয়।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য সহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, এই অঞ্চলের শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ পুকুরের পানি পান করে থাকে। লবণাক্ত এলাকা হওয়ায় গ্রীষ্মকালে পুকুরের পানি কমে যাওয়ায় খাওয়ার পানির সংকট প্রবল আকার ধারণ করে। তবে সরকারিভাবে ট্যাংকি সরবরাহ করে বৃষ্টির সময়কার পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয় লোকজনের সারা বছরের জন্য প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা পূরণের চেষ্টা চলছে।