কর্মসূচিকে টেকসই করতে হবে

ভিটামিন এ জীবন রক্ষাকারী গুরুত্বপূর্ণ অণুপুষ্টিকণা। দেশের ৯০ শতাংশের বেশি শিশু ভিটামিন এ সম্পূরক কর্মসূচির সুরক্ষা পাচ্ছে। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কর্মসূচিকে টেকসই করার পাশাপাশি বাদ পড়া শিশুদের এর আওতায় আনা।

গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ভিটামিন এ–এর অভাব দূরীকরণ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা এসব কথা বলেন। এই বৈঠক আয়োজনে সহায়তা করে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মপরিকল্পনার বিষয়ভিত্তিক পরিচালক নূর মোহাম্মদ বলেন, ভিটামিন এ গর্ভবতী মা, নবজাতক, প্রসূতি মা, শিশু—প্রত্যেকের জন্য দরকার। ডায়রিয়া মোকাবিলায় সহজ বার্তা দিয়ে ওআরএসের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে বাংলাদেশ সফল হয়েছিল। ভিটামিন এ–এর ব্যাপারে এমন উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের ভাইস প্রেসিডেন্ট (স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড গ্রোথ) ব্রায়ান হ্যারিগান বলেন, ১০ লাখ শিশুকে ভিটামিন এ সম্পূরক দেওয়া হলে ৪ হাজার শিশুর খর্বতা বন্ধ করা যায়, ১ হাজার শিশুর জীবন রক্ষা হয়। জাতীয় কর্মসূচির আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় ২ কোটি শিশুকে ভিটামিন এ সম্পূরক দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ভিটামিন ডি বা জিঙ্ক মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভিটামিন এ জীবন রক্ষাকারী অণুপুষ্টিকণা।

এর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি মানুষ ভিটামিন ডি–এর ঘাটতিতে ভুগছে। বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষও এই সমস্যায় ভুগছে। ভিটামিন এ–সহ অন্যান্য অণুপুষ্টিকণার ঘাটতি মোকাবিলায় পৃথক সমন্বিত কর্মসূচি হাতে নেওয়ার প্রস্তাব করেন এই ওষুধবিজ্ঞানী।

অনুষ্ঠানের শুরুতে নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এদেশীয় পরিচালক জাকী হাসান বলেন, ভিটামিন এ সম্পূরক কর্মসূচির কিছু সফল দিক যেমন আছে, তেমনি কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। বছরে দুবার শিশুদের ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। এই দুই সময়ের মধ্যে শিশুদের পুষ্টি বা ভিটামিন এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয় না, এই মধ্যবর্তী সময়েও কিছু কাজ হওয়া দরকার।

মূল উপস্থাপনার প্রথম অংশে নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের কারিগরি ব্যবস্থাপক মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, ১৯৭৩ সালে ভিটামিন এ সম্পূরক কর্মসূচি শুরু হয়। তখন শিশুদের মধ্যে রাতকানা রোগের প্রকোপ ছিল ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। বর্তমানে তা দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মপরিকল্পনার বিষয়ভিত্তিক পরিচালক নূর মোহাম্মদ। পাশে নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্রায়ান হ্যারিগান।  ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মপরিকল্পনার বিষয়ভিত্তিক পরিচালক নূর মোহাম্মদ। পাশে নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্রায়ান হ্যারিগান। ছবি: প্রথম আলো

জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক গাজী আহমাদ হাসান বলেন, ৬-১১ মাস বয়সী ৮৬ শতাংশ এবং ১২-৫৯ মাস বয়সী ৯১ শতাংশ শিশু নির্দিষ্ট ভিটামিন এ ক্যাপসুল পাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, বাংলাদেশের মানুষের পুষ্টি–পরিস্থিতি নিয়ে ১৯৬২-৬৪ প্রথম জরিপ করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সালে। ওই জরিপের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের মানুষের পুষ্টির উন্নতিতে কাজ শুরু হয়। এখনো
২০ শতাংশ শিশু ভিটামিন এ সম্পূরক পাচ্ছে না। অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক মা গর্ভাবস্থায় ভিটামিন এ–এর স্বল্পতায় ভোগেন।

বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। আলোচনায় অংশ নিয়ে হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনালের এদেশীয় পরিচালক আমিনুজ্জামান তালুকদার বলেন, ১৯৮২-৮৩ সালের জরিপে দেখা গিয়েছিল, ভিটামিন এ–এর অভাবে বছরে ৩০ হাজার শিশু দৃষ্টি হারায়। সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। তবে বর্তমান কর্মসূচিকে টেকসই করতে হলে খাদ্য সমৃদ্ধিকরণ ও খাদ্যবৈচিত্র্যের ওপর জোর দিতে হবে।

জাতীয় পুষ্টিসেবা কর্মসূচির উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক এম ইসলাম বুলবুল বলেন, ভিটামিন এ নানাভাবে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুকে সুরক্ষা দেয়, শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, শিশুর দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে এবং শিশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিক রাখে।

গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মোমেনা খাতুন বলেন, দেশের পুষ্টি–পরিস্থিতির উন্নতিতে আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় যেমন দরকার, তেমনি দরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিকল্পনাগুলোর সমন্বয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস বিভাগ) মো. আবদুস সামাদ বলেন, ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর দিন সারা দেশের পরিস্থিতি এখন তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয়।

ইউনিসেফের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ মহিউদ্দিন খান বলেন, বাংলাদেশ সরকার ধারাবাহিকভাবে বহুসংখ্যক মানুষকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাইয়ে যাচ্ছে। এটি অনেক বড় ঘটনা।

জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের (আইপিএইচএন) পরিচালক মো. খলিলুর রহমান বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অপুষ্টির বাধা দূর করতে হবে। দেশব্যাপী ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর মতো কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময় আইপিএইচএনের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠান ভয় বা উৎকণ্ঠায় থাকে। গণমাধ্যম বা নাগরিক সমাজের উচিত সরকারের পাশে থাকা।