গবেষণায় খুলছে সম্ভাবনার দ্বার

শিক্ষা বিনিময়ের আওতায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টার্নশিপ করতে আসেন বিদেশি শিক্ষার্থীরাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারে গবেষণায় ব্যস্ত দুই শিক্ষার্থী।  সংগৃহীত
শিক্ষা বিনিময়ের আওতায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টার্নশিপ করতে আসেন বিদেশি শিক্ষার্থীরাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারে গবেষণায় ব্যস্ত দুই শিক্ষার্থী। সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এক যুগ পেরিয়েছে। এর মধ্যে গবেষণায় এসেছে একাধিক সাফল্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়েছে দেশ-বিদেশে। গবেষণা খাতে কৃতিত্বের ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও একের পর এক গবেষণার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের। নতুন গবেষণায় উন্মোচিত হচ্ছে মৎস্য ও প্রাণিবিজ্ঞানের সম্ভাবনার দ্বার। এসব কর্মযজ্ঞের ফলে উচ্চশিক্ষায় গবেষণার নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়।

চট্টগ্রাম নগরের জাকির হোসেন সড়কে মাত্র সাত একর জায়গার ওপর ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু হয় চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের। এর আগে এটি ছিল চট্টগ্রাম সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজে তখন শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ৫০ জন। প্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী ইন্টার্নশিপ করছেন বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের দক্ষ প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞ, মৎস্য ও খাদ্যবিজ্ঞানী তৈরিই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য।

ভেড়ার কৃত্রিম প্রজনন

গরু-ছাগলের পর কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো ভেড়া উৎপাদন করা হয়। আর এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক আজিজুন্নেছা। ২০১৩ সালে এই গবেষণার পর সাফল্য পায় গবেষক দল। গবেষণায় এই সাফল্যের ফলে দেশে ভেড়ার উৎপাদন বাড়বে। মানুষের প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। গবাদিপশুর খামারিরাও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন।

নতুন জাতের মুরগি

মিসরীয় ও দেশি পাহাড়ি মোরগ-মুরগির মিলনের মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়েছে নতুন জাতের মুরগি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকস অ্যান্ড অ্যানিমেল ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কবিরুল ইসলাম খানের গবেষণায় এই সাফল্য এসেছে। নতুন জাতের এই মুরগি ঘরের পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা যাবে। এতে খামারিরা অনেক লাভবান হবেন। ১২ সপ্তাহের পর দেশীয় মুরগির ওজন যেখানে ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম হয়, সেখানে এই জাতের মুরগির ওজন হয় ৮০০ থেকে ১০০০ গ্রাম।

মুরগির রক্ত আমাশয় ও তার প্রতিকার

সারা বিশ্বে পোলট্রি উৎপাদনের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে মুরগির রক্ত আমাশয়। এ রোগে আক্রান্ত মুরগির মৃত্যুর হার প্রায় ৮০ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী এই রোগের চিকিৎসা হচ্ছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার। কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাব মানুষের শরীরেও বিস্তার করে।

এ অবস্থা থেকে প্রতিকারের জন্য গবেষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গৌতম বুদ্ধ দাশ ও শিক্ষক মুক্তি বড়ুয়া। গবেষণায় তাঁরা দেখেন, মরণঘাতী এই রোগ থেকে মুরগিকে বাঁচাতে এবং ভালো উৎপাদনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে চর্বিযুক্ত মাছের তেল। হাঙর, টুনা, সার্ডিন মাছ থেকে উৎপাদিত তেল মুরগির রক্ত আমাশয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর উপাদান হিসেবে কাজ করে। ব্রয়লারের দৈনন্দিন খাওয়ার পানির সঙ্গে ২ শতাংশ মাছের তেল রক্ত আমাশয় প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

দেশেই হবে শৌখিন পাখির লিঙ্গ নির্ধারণ

শৌখিন পাখি পুষতে ভালোবাসেন অনেকেই। কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে একই বৈশিষ্ট্য ধারণ করে বলে এসব পাখির লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায় না। তাই লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য পাখির নমুনা পাঠাতে হতো ভারত কিংবা থাইল্যান্ডে। এতে সময় লাগত প্রায় দুই সপ্তাহ, খরচও পড়ত সর্বনিম্ন ১ হাজার ২০০ টাকা। তবে দেশেই পাখির লিঙ্গ নির্ধারণে সক্ষমতা অর্জন করেছেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) একদল গবেষক। এখন সময় লাগবে দুই দিন ও খরচ মাত্র ৬০০ টাকা। শৌখিন পাখির লিঙ্গ নির্ধারণে সক্ষমতা অর্জন বাংলাদেশে এটিই প্রথম।

প্যাথলজি ও প্যারাসাইটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শুভাগত দাসের তত্ত্বাবধানে বিভাগের শিক্ষক এম এ আলিম, তোফাজ্জল মো. রাকিব এবং এম এস গবেষক ত্রিদীপ দাশ ও মো. সাদ্দাম হোসেন এই গবেষণা কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অর্থায়নে ‘অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে শৌখিন পাখির ডিএনএ সেক্সিং’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এই গবেষণা করেন তাঁরা।

আরও কিছু

চট্টগ্রামের খামারি ও চাষিদের প্রাণী চিকিৎসার মূল ভরসা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী হাসপাতাল। প্রাণীর জন্য রয়েছে ব্লাড ব্যাংক। আবার পোষা প্রাণীর চিকিৎসার জন্য ঢাকার পূর্বাচলে ২২ কাঠা জায়গার ওপর গত বছরের অক্টোবরে চালু করা হয়েছে ‘টিচিং অ্যান্ড ট্রেনিং পেট হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার’ নামের হাসপাতাল। এই হাসপাতালে শিক্ষানবিশ ও স্নাতকোত্তর প্রাণী চিকিৎসকেরা হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিতে পারছেন। রয়েছে পোষা প্রাণীর বিভিন্ন রোগ নিয়ে বিশেষভাবে গবেষণার সুযোগ।

মাঠপর্যায়ের গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও ফলপ্রসূ করার জন্য নগরের বাইরে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে স্থাপন করা হচ্ছে ‘রিসার্চ অ্যান্ড ফার্ম বেইজড ক্যাম্পাস’। এখানে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি গবেষকদের জন্য গবেষণাগার তৈরি করা হবে। নির্মাণ করা হবে গরু, ছাগল ও মুরগির খামার, মাছের হ্যাচারি এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্ল্যান্ট।

এ ছাড়া সামুদ্রিক গবেষণায় কার্যকরী কৌশল প্রয়োগ এবং সাগরতলের সম্পদ আহরণ, সংরক্ষণ ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য কক্সবাজারে একটি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। আর রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে নামছে ভ্রাম্যমাণ গবেষণা জাহাজ। এই জাহাজের মাধ্যমে লেকের মাছ কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি সংরক্ষণের নানা উদ্যোগও নেওয়া হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গৌতম বুদ্ধ দাশ বলেন, ক্ষুদ্র পরিসরে যাত্রা শুরু হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টি আজ একটি সুদৃঢ় অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের একটি অন্যতম বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি, জ্ঞানচর্চা ও গবেষণাকর্মের মাধ্যমে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।

উপাচার্য গৌতম বুদ্ধ দাশ আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ হচ্ছে জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান আহরণ ও গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। কার্যকর গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে যাচ্ছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এশিয়ার একটি শীর্ষ ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর ও একটি ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিরন্তর প্রচেষ্টা চলছে।

গবেষণায় নানা সাফল্যের কারণে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম আজ সারা দেশে ছড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন এ বি এম আবু নোমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান এখন উন্নত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটি এখন আমাদের গর্বের প্রতিষ্ঠান।’