চট্টগ্রামে আছে অনেক সুযোগ গন্তব্য হতে পারে বিদেশও

গত কয়েক দশকে চট্টগ্রামে উচ্চশিক্ষার হার বেড়েছে। কারণ, ক্ষেত্রটা প্রসারিত হয়েছে। এটাও ঠিক, সেই অনুপাতে পর্যাপ্ত চাকরির ক্ষেত্র এখনো তৈরি হয়নি। সে জন্য উচ্চশিক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একজনকে জানতে হবে তার সামনে কী কী সুযোগ আছে? আবার এটাও সিদ্ধান্ত নিতে হবে, স্নাতকোত্তর, পিএইচডি কিংবা এমফিল চট্টগ্রামে বা দেশে করবে, নাকি দেশের বাইরে? উচ্চশিক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে থাকতে হবে প্রস্তুতি।

দেশে বসেই এখন বেশ ভালো মানের ব্যবসা প্রশাসনের ডিগ্রি অর্জন করা যায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যাকালীন এমবিএ, আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ব্যবসা প্রশাসনে স্নাতকোত্তরের সুযোগ। যারা স্বাস্থ্য নিয়ে পড়াশোনা করতে চাও, তারা মাস্টার্স ইন পাবলিক হেলথ নিয়ে পড়তে পারো চট্টগ্রামে তিনটি প্রতিষ্ঠানে কিংবা ঢাকায় বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কাজ করার সুযোগ আছে জনস্বাস্থ্য–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে। ফ্যাশন টেকনোলোজি কিংবা ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং নিয়ে কেউ স্নাতকোত্তরের পর ক্যারিয়ার করতে চাইলে আছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামে বসেই ফার্মেসি, বায়োকেমিস্ট্রি ও বায়োটেকনোলজি নিয়ে স্নাতকোত্তর করার সুযোগ রয়েছে।

 মানবিক ও সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে অর্থনীতি, ইংরেজি এবং আইন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার ব্যবস্থা। প্রকৌশলের জন্য আছে কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং ইলেকট্রনিকস নিয়ে স্নাতকোত্তর করার সুযোগ। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও ৫০টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর করা যায়। যদিও অনেক ক্ষেত্রে তা নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত।

চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সবচেয়ে আশাপ্রদ ব্যাপারটি হচ্ছে, এখানকার স্নাতক পর্যায়ের ডিগ্রি বৈশ্বিক মানের। অনেক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের শিক্ষার্থীরা আটকে থাকেনি। চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে পড়াশোনা করেই ছাত্রছাত্রীরা আন্তর্জাতিক বৃত্তি, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডির সুযোগ পাচ্ছে নামকরা পৃথিবীর সেরা সব প্রতিষ্ঠানে। এই যেমন সুযোগ পেয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আফরিন সুলতানা অক্সফোর্ডে, সাজিদ আলী হাওলাদার ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয়ে, আসিফ ইমরান জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং এনায়েত হাসান কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ রকম আরও হাজারখানেক শিক্ষার্থী ও গবেষক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

চট্টগ্রামে স্নাতক শেষ করে পরিকল্পনা করা যায় দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার। তবে তার জন্য চাই প্রস্তুতি। দেশের বাইরে পড়ার জন্য আছে অনেক আন্তর্জাতিক বৃত্তি। সবচেয়ে বেশি বৃত্তি ও ফান্ডের ব্যবস্থা আছে যুক্তরাষ্ট্রে। যাওয়ার জন্য আছে ফুলব্রাইট বৃত্তি ও বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম। সাম্প্রতিক সময়ে প্রচুর ছেলেমেয়ে সুযোগ পাচ্ছে ইউরোপের দেশগুলোতেও। এর মধ্যে রয়েছে জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, ফ্রান্স ও ইতালি। এতে রয়েছে জার্মানিতে দাদ প্রোগ্রাম, সুইডেনে এসআই স্কলারশিপ, বেলজিয়ামে ভিএলআইয়ার স্কলারশিপ, নেদারল্যান্ডসে নাফিক এবং এনএফপি স্কলারশিপ। যুক্তরাষ্ট্র, স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডে আগের চেয়ে বৃত্তির পরিমাণ কমে গেলেও এখনো আছে অনেক জায়গায় পড়ার সুযোগ। তবে ইউরোপে পিএইচডির চেয়ে স্নাতকোত্তরে সুযোগ পাওয়া সহজতর এবং ইউরোপের স্নাতক ডিগ্রিধারীদের পরবর্তী সময়ে প্রাধান্য দেওয়া হয় সেখানে পিএইচডি করার ক্ষেত্রে। এরপরেই আছে জাপান। জাপানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গবেষণা বৃত্তির জন্য অনেক অর্থায়ন করা হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৃত্তিগুলো হলো মনকুগাবুশো, MEXT, JSPS। পিএইচডির জন্য চেষ্টা করা যায় অস্ট্রেলিয়াতে। এন্ডেভার, অস্ট্রেলিয়ান লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড, আরটিপিসহ বিভিন্ন বৃত্তি দেওয়া হয় প্রতিবছর। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী এখন যাচ্ছে মালয়েশিয়া, কোরিয়া, চীন ও সিঙ্গাপুরে। এখানে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের উচ্চশিক্ষার মান খুবই উন্নত।

এখন প্রশ্ন আসে, দেশের বাইরে সুযোগ পেতে হলে কী যোগ্যতা লাগে? প্রথম উত্তর ইংরেজিতে দক্ষতা। শুধু স্কলারশিপ নয়, এমনকি ভর্তি আবেদন করতেও আইইএলটিএস স্কোর দরকার হয় কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, জাপান, মালয়েশিয়া এবং কোরিয়ার অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে হলে জিআরই বা জিম্যাট স্কোর লাগবেই।

দেশের বাইরে অধ্যাপকদের ই–মেইল করতে হয় এবং ই–মেইলে সঠিক ইংরেজি ব্যবহার, শব্দচয়ন, অল্প কথায় গুছিয়ে নিজের আগ্রহ ও বৃত্তান্ত উপস্থাপন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে নিজের জীবনবৃত্তান্ত বা সিভি দিতে হয়, যেখানে অনেক কিছুই অপ্রয়োজনীয়। এই যেমন নিজের ছবি দেওয়া, বৈবাহিক অবস্থা, বাবার নাম, মায়ের নাম, ধর্ম—এসব কোনোভাবেই একজন অধ্যাপকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না এবং অধিকাংশ আন্তর্জাতিক বৃত্তির ক্ষেত্রেও প্রয়োজন হয় না।

পরীক্ষার ফলাফল অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, কিন্তু তা সব ক্ষেত্রে নয়। ভালো ফলাফল ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও কানাডায় খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে একটু মাঝারি ফলাফল হলেও জিআরই এবং সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমের রেকর্ড ভালো থাকলে বৃত্তি পাওয়া যায়। এখন ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়াতেও লিডারশিপ স্কিল বা নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক অভিজ্ঞতাকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় গবেষণার অভিজ্ঞতা বা ইন্টার্নশিপ খুব কাজে লাগে বাইরে সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে। মালয়েশিয়া বা কোরিয়াতে অনেক সময় সিজিপিএ কম থাকলেও গবেষণা অভিজ্ঞতার কারণে অনেকেই বৃত্তি পায়। আর পাশাপাশি দরকার একটা দুই থেকে তিন পৃষ্ঠার গবেষণা প্রস্তাবনা, যেটা দেখে বিশ্ববিদ্যালয় বা অধ্যাপক নির্ধারণ করেন একজন প্রার্থীর গবেষণা করার ও আইডিয়া উদ্ভাবনের সক্ষমতা।

(লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ)