সমঝোতা হচ্ছে বেশি, মামলায় আগ্রহ কম

>

• সড়ক দুর্ঘটনা
• ভোগান্তি, প্রতিপক্ষের চাপ, আর্থিক সমঝোতাসহ নানা কারণে মামলায় অনাগ্রহী ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো

সড়ক দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মামলা হয় না। বিবদমান পক্ষগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে ফেলে। এমন তথ্য দিচ্ছেন খোদ পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

অনুসন্ধানেও মিলেছে এর সত্যতা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অল্প কিছু অর্থের বিনিময়ে মামলা করছে না ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। ধর্মীয় কারণে অনেকে দুর্ঘটনায় নিহত স্বজনের দেহ ময়নাতদন্তই করাতে চান না। অনেকে আবার মনে করেন, যে যাওয়ার সে তো চলেই গেছে; থানা-পুলিশ, আইন-আদালতের ঝামেলায় জড়িয়ে কী লাভ। আর পুলিশ বলছে, ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ যখন মামলায় অসহযোগিতা করে, তখন তাদের কিছু করার থাকে না। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, অসচেতনতা, ভোগান্তি, প্রতিপক্ষের চাপ, আর্থিক সমঝোতাসহ নানা কারণে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মামলা থেকে সরে আসছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো।

গত ১৭ থেকে ২২ মার্চের মধ্যে মাগুরায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন চারজন। এর মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে বাসের ধাক্কায়। এক চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে ছিটকে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আরেকটি দুর্ঘটনায় দুটি গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে এক পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। মাগুরা সদর থানা বলছে, এর একটি দুর্ঘটনায়ও মামলা হয়নি।

১৭ মার্চ মাগুরা-নড়াইল সড়কে মালিগ্রাম এলাকায় একটি তেলবাহী ট্যাংকার ও মিনি ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের পর নিয়ন্ত্রণ হারানো ওই ট্যাংকার রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেলের আরোহী অনিক শেখ ও তাঁর স্ত্রী সুমাইয়াকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন সদর উপজেলার শিবরামপুর গ্রামের জিল্লুর রহমানের ছেলে অনিক শেখ। গুরুতর আহত হন তাঁর স্ত্রী।

এ ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) পারভেজ আহমেদের ভাষ্য, বারবার যোগাযোগ করা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার মামলা করতে আগ্রহ দেখায়নি। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় নিহত অনিকের বাবা জিল্লুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মামলা করে কী হবে? আমার ছেলে তো আর ফিরে আসবে না।’

রাস্তা পার হতে গিয়ে ২০ মার্চ বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেন আবদুস সালাম মণ্ডল (৮৩)। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মাগুরা শহরের পারনান্দুয়ালি এলাকার এ দুর্ঘটনায়ও আটক করা হয় বাসটি। তার পরও থানায় মামলা করতে আসেননি নিহত ব্যক্তির পরিবারের কোনো সদস্য। পুলিশ বলছে, মাত্র ৩০ হাজার টাকায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিষয়টির রফা করেছেন বাসমালিকেরা।

মাগুরা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের হিসাবে, ২০১৯ সালের প্রথম দুই মাসে সড়ক দুর্ঘটনা ইস্যুতে জেলায় মামলা হয়েছে একটি। ২০১৮ সালে এ–সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ২২টি।

মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালের হিসাবে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সড়কে নিহত মানুষের সংখ্যা ১৮। এই ১৪ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ৪৪৮ জন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যেসব মামলা হয়েছে তার তদন্তও এগোচ্ছে ধীরগতিতে। এ জন্য ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সদস্যদের অসহযোগিতাকেই দায়ী করা হচ্ছে। গত বছরের ৭ নভেম্বর মাগুরা শহরের ঢাকা রোড এলাকায় সবজিবোঝাই মিনি ট্রাকের চাপায় নিহত হন মোটরসাইকেলের আরোহী পুলিশের কনস্টেবল লিমন হোসেন (২২)। এ ঘটনায় তাঁর বাবা লিয়াকত হোসেন মোল্লা সদর থানায় মামলা করেন। ইতিমধ্যে মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। তবে মামলাটি আর চালাতে চান না বাদী, এই মর্মে আদালতে একটি আবেদনও করেছেন। একমাত্র সন্তানের ‘হত্যার’ বিচার চান না কেন? এ প্রশ্নে লিমনের বাবা লিয়াকত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাতে তো আর আমার সন্তান ফিরে আসবে না। উল্টো ওই চালকের জেল হলে না খেয়ে মরবে তাঁর পরিবার।’

মাগুরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় যাঁরা আহত বা নিহত হন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের পরিবারের সদস্যরা মামলা করতে চান না। কারণ মোটরশ্রমিকেরা যেকোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলেন। কখনো কখনো মামলা হলেও এর এক বা দুই সপ্তাহ পর সমঝোতা করে ফেলেন। সে ক্ষেত্রে পুলিশের তদন্তে তাঁরা সহযোগিতা করেন না, সাক্ষ্যও দিতে আসেন না।

অভিযোগ আছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুই পক্ষের সমঝোতায় মধ্যস্ততা করে পুলিশ। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে সদর থানার ওসি মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাত নেই, দিন নেই যখনই কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ। কিন্তু প্রতিটি জেলায় মোটর শ্রমিকের কিছু অসাধু নেতার কারণে পুলিশের পরিশ্রম ফলাফল পর্যন্ত পৌঁছায় না। তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনা ঘটলে পরিবহনমালিকেরা ওই এলাকার শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ইউনিয়নের নেতারা দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় এসব ঘটনা রফা হয়।

বিষয়টি স্বীকার করেছেন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারাও। মাগুরা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. ইমদাদুল ইসলাম বলেন, সমঝোতা হলে দুই পক্ষই লাভবান হয়।