সমন্বিত উদ্যোগই পারে অগ্নিদুর্ঘটনা কমাতে

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। পাশে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। গতকাল কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। পাশে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। গতকাল কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো

ভবিষ্যতে অগ্নিদুর্ঘটনার মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় জনসচেতনতার পাশাপাশি দরকার পেশাজীবীদের দায়িত্বশীলতা। সমন্বিত উদ্যোগই পারে এই দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে। গতকাল রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।

প্রথম আলোর উদ্যোগে আয়োজিত এই গোলটেবিল বৈঠকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ভবনের উচ্চতা নয়, এই মুহূর্তে সিটি করপোরেশনের ‘মূল ফোকাস’ হচ্ছে অগ্নিনিরাপত্তা। তিনি বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান বা ভবনে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা থাকবে, সেখানে বিশেষ রেয়াতের ব্যবস্থা করা হবে। আর না মানলে আইন অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হবে।

শেল্‌টেকের সহযোগিতায় আয়োজিত ‘অগ্নিদুর্ঘটনা রোধের উপায় ও করণীয়’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। বৈঠকে নগর গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকার ভবিষ্যৎ আছে, কিন্তু খুব দুর্যোগপূর্ণ। যতই দিন যাচ্ছে, দুর্যোগের মাত্রা বাড়ছে। ঢাকায় নগর সরকারব্যবস্থা হওয়া কঠিন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ জন্য শক্তিশালী সমন্বয় কর্তৃপক্ষ গড়তে হবে। তিনি বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও সিটি করপোরেশন একযোগে বহুতল ভবন পরিদর্শন করলে সময়, অর্থ দুটিই নষ্ট হবে, মানুষ ভুল বুঝবে। সমন্বিতভাবে এলাকা ভাগ করে পরিদর্শনের পরামর্শ দেন তিনি।

বৈঠকে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন শেল্‌টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌফিক এম সেরাজ। তিনি ভবন নির্মাণসংক্রান্ত বিভিন্ন আইন, বিধিবিধান ও নীতিমালার মধ্যে অসামঞ্জস্য দূর করা, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ভবনের তদারকি, ভবন ব্যবহারে রাজউকের সনদ নেওয়া ও নবায়ন নিশ্চিত করা, ২০০৮ সালের আগে নির্মিত ভবনগুলোর জন্য নির্দেশনা তৈরি করা, ‘ফায়ার ড্রিল’ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।

রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (প্রজেক্ট অ্যান্ড ডিজাইন) এ এস এম রায়হানুল ফেরদৌস বলেন, পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ—এ তিনটি ভিত্তির ওপর রাজউক দাঁড়িয়ে আছে। পরিকল্পনায় রাজউক কিছুটি এগিয়েছে। কিন্তু রাজউকের জনবলের স্বল্পতার কারণে উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সেভাবে হয়নি বলে তিনি মন্তব্য করেন।

অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে করণীয় ঠিক করতে হবে বলে মত দেন রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি তানভীরুল হক প্রবাল। তিনি বলেন, প্রথমেই দেখতে হবে ভবনের সিঁড়ি ঠিকভাবে করা হয়েছে কি না। আবার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিঁড়ি করে দিলেও মালিকেরা সেটি রক্ষণাবেক্ষণ করেন না। দেখা যায়, সিঁড়িতে কাপড়ের টুকরা, গুদাম, স্যুটকেস রাখা হয়। এ বিষয়ে তিনি রক্ষণাবেক্ষণের ওপর জোর দেন।

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সদ্য সাবেক মহাপরিচালক আলী আহম্মদ খান বলেন, একটি দুর্ঘটনা দেশকে অনেক পিছিয়ে নিয়ে যায়। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে দেশের প্রতি নেতিবাচক ধারণা আসবে। প্রতিটি ভবনে ‘ফায়ার সেফটি প্ল্যান’ কার্যকর করতে পারলে প্রাথমিক কাজগুলো হয়ে যাবে। তিনি ছোট এলাকা ধরে ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেম’ স্থাপন করা এবং রাজউকসহ অন্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানান।

ঢাকা শহরের বাসিন্দারা আগ্নেয়গিরির ওপর বাস করছে মন্তব্য করে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ভবন ব্যবহারের সনদের প্রথম কথাই ছিল এটি না থাকলে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ও টেলিফোন সংযোগ দেওয়া হবে না। কিন্তু তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

 বিল্ডিং টেকনোলজিস আইডিয়াস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ আর খান বলেন, জরুরি বহির্গমন পথের পুরোটাই আগুন ও ধোঁয়া প্রতিরোধক হতে হবে। বের হওয়ার ব্যবস্থা ভালো থাকলে ৩৫০ জন লোককে ৪৫ মিনিটের মধ্যে ১৭ তলা ভবন থেকে অক্ষত অবস্থায় বের করা সম্ভব।

অনুষ্ঠানে এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা ও ভবন নির্মাণের আগে অগ্নিপ্রতিরোধের ব্যবস্থা ঠিক করার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম। বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাকসুদ হেলালী বলেন, অগ্নিকাণ্ডের সময় অধিকাংশ মানুষেরই মৃত্যু হয় ধোঁয়ায়। ধোঁয়া থেকে রক্ষা পেতে সঠিকভাবে ভবনের নকশা তৈরির পরামর্শ দেন তিনি।

বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক এম শহীদুল আমিন বলেন, ‘২০০০ সালে গবেষণা করে আমরা বলেছিলাম, বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা কোতোয়ালি ও সূত্রাপুর।’ এরপর রাজউক কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে তিনি অভিযোগ করেন।

কোনো দুর্ঘটনার পর একজন আরেকজনের ওপর দোষ না চাপিয়ে নিজের দোষ স্বীকার করার পরামর্শ দেন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান নাসরিন হোসেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান তাঁর বক্তব্যে বস্তিবাসীর নিরাপত্তার প্রতি জোর দেন। তিনি বলেন, শহরের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ বস্তিতে থাকে। কিন্তু পরিকল্পনায় ও সরকারি দর্শনে বস্তিবাসীর গুরুত্ব সে অনুযায়ী দেওয়া হয় না।

 অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, ‘মানুষের স্বভাব হওয়া ছিল মুক্তি। কিন্তু আমরা নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে বন্দিত্বটা মেনে নিয়ে, নিজেরাই নিজেদের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি।’

বৈঠকে শেল্‌টেকের পরিচালক সামিয়া সেরাজ বলেন, বিশ্বের সব জায়গায় শিশু বয়স থেকে আগুনের প্রকারভেদ অনুযায়ী ‘এক্সটিংগুইশার’-এর ব্যবহার, অগ্নিকাণ্ডের সময় ভেজা রুমাল চেপে বের হওয়া সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তিনি বাংলাদেশেও এমন সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণের আহ্বান জানান।