চৈত্রের নতুন রূপ, নতুন শঙ্কা

>প্রকৃতির পরিবর্তন
* ২০১৯ সালের চৈত্র মাসের ২৫ দিনের মধ্যে ১৮ দিনই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। তার মধ্যে ৭ দিনই বৃষ্টি হয়েছে।
* ২০১৮ সালের চৈত্র মাসের ১৫ দিনেই মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ছিল। বৃষ্টি পড়েছে ৪ দিন।
* ২০১৭ সালের চৈত্র মাসের ১০ দিন ছিল এমন আবহাওয়া। বৃষ্টি পড়েছে ৪ দিন।
আবহাওয়া
আবহাওয়া

‘রোদ যেন নয়, শুধু গনগনে ফুলকি/ আগুনের ঘোড়া যেন ছুটে চলে দুলকি’—ফজলুর রহমানের ‘গ্রীষ্মের দুপুর’ কবিতাটি এখন যেন সবাই ভুলতে বসেছে। এখন নেই সেই আগের মতো চৈত্রের দাবদাহ। বদলে যাচ্ছে গ্রীষ্মের রূপ। খরার পরিবর্তে চৈত্রে এখন বৃষ্টিবাদল, মেঘলা আবহাওয়া, সকালে কুয়াশা–দিনে গরম-রাতে ঠান্ডা। চৈত্র যেন নতুন রূপ ধারণ করছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আবহাওয়ার এই পরিবর্তনে ফসলের রোগবালাই বাড়ছে। এ জন্য রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে তাদের উচ্চ ব্যবস্থাপনায় যেতে হচ্ছে।

মাঠপর্যায়ের ধানচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই পর্যায়ে ধানে পোকার উপদ্রব সাধারণত হয় না। আরও কিছুদিন পর ধান আরেকটু পরিপক্ব হলে পোকামাকড়ের সংক্রমণ হয়ে থাকে। কিন্তু পরিবর্তিত আবহাওয়ার কারণে এখনই ধানে রোগবালাই দেখা দিচ্ছে।

জেলার পুঠিয়া উপজেলার শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের বেতবাড়িয়া গ্রামের কৃষক আনসার আলীর জমির ধানের শিষে কালো কালো দাগ পড়েছে। এটা কী ধরনের রোগ, তা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা শনাক্ত করতে পারেননি। তাঁরা ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে ওই কালো ছোপ লাগা ধানের শিষের নমুনা পাঠিয়েছেন। আজ মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি দল পুঠিয়ায় যাওয়ার কথা রয়েছে।

রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক জাহাঙ্গীর শাহ পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন। তিনি প্রতিদিনের আবহাওয়ার পরিবর্তন লিখে রাখেন। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের সঙ্গেও ওই শিক্ষকের লিখে রাখা আবহাওয়ার দশার মিল পাওয়া গেছে। জাহাঙ্গীর শাহর দিনপঞ্জি অনুযায়ী এ বছর চৈত্র মাসের ২৫ দিনের মধ্যে ১৮ দিনই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। তার মধ্যে সাত দিনই বৃষ্টি হয়েছে। এর আগের বছর চৈত্র মাসের ১৫ দিনেই মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ছিল। বৃষ্টি পড়েছে চার দিন। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের চৈত্রের ১০ দিন ছিল এমন আবহাওয়া। বৃষ্টি পড়েছে চার দিন।

৬ এপ্রিল (২৩ চৈত্র) সকালে কুয়াশাচ্ছন্ন ঠান্ডা ও মেঘলা দুর্যোগময় আকাশ ছিল। অল্প সময়ের জন্য রোদ উঠলেও সারা দিনই মেঘ মেঘ ছিল। সন্ধ্যার পর অল্প বৃষ্টি হয়েছে। এর আগের বছর এ তারিখে সারা দিন রাজশাহীতে মেঘের লুকোচুরি ছিল। পাশের নওগাঁ জেলায় তুমুল বৃষ্টি হয়েছে। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে এ তারিখে সারা দিনই রাজশাহীতে মেঘলা আবহাওয়া ছিল। একইভাবে জাহাঙ্গীর শাহর দিনপঞ্জি থেকে চৈত্র মাসের ১২, ১৫, ২৪ তারিখের আবহাওয়ার চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ক্রমেই চৈত্রের চেহারার এ রকম পরিবর্তন আসছে।

পুঠিয়া উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঝড়বৃষ্টির পরই পুঠিয়ার আনসার আলীর জমির ধানে একধরনের নতুন রোগ দেখা দিয়েছে। গতকাল সোমবার তিনি ও তাঁর কার্যালয়ের দুজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তেবাড়িয়া গ্রামে গিয়ে ওই ধানখেত পরিদর্শন করেন। আপাতত তাঁরা আনসার আলীকে ছত্রাকনাশক ছিটানোর পরামর্শ দিয়েছেন। আনসার আলীর এক বিঘা জমির ধানগাছে এই রোগ দেখা দিয়েছে। লক্ষণ দেখার পরপরই তিনি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ে যোগাযোগ করেন। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা খেতটি পরিদর্শন করেন।

আবহাওয়ার এই পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আবদুল লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া, বৃষ্টি, সকালে কুয়াশা, রাতে ঠান্ডা, দিনে গরম—এ রকম আবহাওয়ার কারণে ধানে ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এই রোগ ধানের পাতায় হতে পারে, কাণ্ডে হতে পারে, আবার শিষের গোড়ায়ও হতে পারে। শিষের গোড়ায় হলে একে ‘নেক ব্লাস্ট’ বলা হয়। আবার ঝড়বৃষ্টির কারণে ধানের পাতা মরা রোগ হয়। বৃষ্টির পানিতে এই ব্যাকটেরিয়া দ্রুত ছড়ায়।

রাজশাহী ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ বি এম আনোয়ার উদ্দিন বলেন, এ রকম আবহাওয়া থেকে রাজশাহী অঞ্চলে বাদামি গাছফড়িংয়ের প্রাদুর্ভাব হয়। আবার মাজরা পোকার উপদ্রব বাড়ে। তিনি বলেন, পরিচর্যার মাধ্যমে এবার এ রোগ এখনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।

বাঘা উপজেলার কলিগ্রামের আমচাষি ও ব্যবসায়ী আশাফুদ্দৌলা বলেন, আগের চেয়ে এখন আমে পোকামাকড়ের উপদ্রব অনেক বেশি হচ্ছে। এখন বিশেষ পরিচর্যা ছাড়া আম খাওয়ার কথা চিন্তাই করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে পেয়ারাবাগানও আছে। পেয়ারায় পোকার এতই আক্রমণ হয়েছে যে পলিথিন ব্যাগ দিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না। অথচ আগে এমনিতেই অনেক ভালো পেয়ারা হতো। আজ আর এ রকম কথা চিন্তাই করা যাচ্ছে না।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আলীম উদ্দীন বলেন, এ রকম আবহাওয়ার কারণে আমের রোগবালাই বাড়ে। এ জন্য তাঁদের উঁচু মানের ব্যবস্থাপনার দিকে যেতে হয়েছে। চাষিদের এ ব্যাপারে সচেতন করা হচ্ছে।