মেঘ দেখেই আঁতকে ওঠেন চাষিরা

কিশোরগঞ্জে হাওরভরা ধান
কিশোরগঞ্জে হাওরভরা ধান

হাওরের যেদিকেই তাকানো হয়, শুধু ধান আর ধান। অন্য বছরের তুলনায় এবার ফলনও ভালো হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই পুরোদমে ধান কাটা শুরু করবেন কৃষকেরা। কিন্তু প্রকৃতি যেন বাদ সাধছে। গত কয়েক দিনের কয়েক দফা ঝড়বৃষ্টি ও শিলায় পাকা ধানের ক্ষতি হয়েছে।

এখন আকাশে মেঘ দেখলেই স্বপ্নের ফসল ঘরে তুলতে পারবেন কি না, সে ভয়ে আঁতকে ওঠেন কৃষকেরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর কিশোরগঞ্জের ১৩ উপজেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬৩ হাজার ৩১৭ হেক্টর। কিন্তু অর্জিত হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ হেক্টর। এর মধ্যে উচ্চফলনশীল (উফশী) ১ লাখ ৪৪ হাজার ২১৫ হেক্টর, হাইব্রিড ২২ হাজার ৯৪৫ হেক্টর ও স্থানীয় জাতের ৩৪০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওরাঞ্চলে চাষ হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। আর হাওরবহির্ভূত উজান এলাকায় চাষ হয়েছে ৬১ হাজার হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে গত বুধ ও বৃহস্পতিবারের শিলাবৃষ্টিতে ৩৫২ হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্তসহ ৩ হাজার ৯৮১ হেক্টর জমির ফসল শিলাবৃষ্টিতে আক্রান্ত হয়েছে। যেসব এলাকায় শিলাবৃষ্টিতে ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো হলো সদর উপজেলার রশিদাবাদ, মাইজখাপন, বৌলাই, লতিবাবাদ, মহিনন্দ, দানাপাটুলি, যশোদল। ইটনার চৌগাঙ্গা, বাদলা। নিকলীর সিংপুর, দামপাড়া, কারপাশা, নিকলী সদর, জারইতলা, গুরুই, ছাতিরচর। এ ছাড়া বাজিতপুর, কটিয়াদী ও অষ্টগ্রামেও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গত শনিবার সরেজমিনে নিকলী ও ইটনার কয়েকটি এলাকায় দেখা যায়, পাকা সোনালি ধানে ভরপুর হাওরাঞ্চল। অনেকেই সোনালি ফসল ঘরে তোলার অপেক্ষায় আছেন। তবে কৃষকদের সঙ্গে কথা বললে অনেকেই তাঁদের উৎকণ্ঠার কথা জানান, নিকলীর বলমারা হাওরে পাঁচ একর জমিতে ধান চাষ করেছেন কৃষক নয়ন মিয়া। সোমবার থেকে ধান কাটাবেন বলে শ্রমিকও ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু বৃহস্পতিবারের শিলাবৃষ্টিতে তাঁর জমির প্রায় সব ধানের ক্ষতি হয়ে যায়। এখন ধান কাটলেও তাঁর শ্রমিক খরচ উঠবে না। কাটলে গরুর খাবারের খড়ের জন্য কাটতে হবে। কৃষক নয়ন আফসোস করে বলেন, ২০১৭ সালে তাঁর সব ধান বন্যায় ভাসিয়ে নিয়েছিল। গত বছর কৃষকেরা ধান ঘরে তুলতে পরলেও তিনি ভয়ে চাষ কম করেছিলেন। এবার ঋণ করে টাকা নিয়ে বেশি জমিতে ধান চাষ করেছেন। বৈরী আবহাওয়ার জন্য আগের ঋণের সঙ্গে নতুন ঋণ যোগ হয়ে তাঁর বোঝা ভারী হয়ে গেল।

নিকলী সদরের আবদুর রহিম চাতলা হাওরে আড়াই একর জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন। শিলাবৃষ্টিতে তারও অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া নিকলীর কৃষক আলী আহমেদের ১০ একর জমি, জমশেদ মিয়ার তিন একর, ফজলু মিয়ার আড়াই একর জমির ধান শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁদের মতো হাওরের কয়েক হাজার কৃষক এখন আকাশে মেঘ দেখলেই আঁতকে উঠছেন। এ বছর যেন তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে জন্য জমিপাড়ে গিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছেন বলে কয়েকজন কৃষক জানিয়েছেন।

২০১৭ সালে কিশোরগঞ্জে বন্যা কেড়ে নিয়েছিল কৃষকের মুখের হাসি। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এক ছটাক ধানও ঘরে তুলতে পারেননি হাওরের কয়েক হাজার কৃষক। ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় গত বছর ধারদেনা করে একই জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। ফলনও পেয়েছিলেন বেশ। হাসিমুখে ধান কেটে ঘরে তুলেছিলেন। এবারও তাঁরা আশা করছেন, হাওরাঞ্চলের একমাত্র ফসল সোনালি ধান যেন ঘরে তুলতে পারেন। তবে ধান গোলায় না ওঠা পর্যন্ত বৃষ্টি আর আকাশে কালো মেঘ দেখলেই আতঙ্কের ছাপ পড়ে কৃষকদের মুখে।

কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলনের লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে। আশা করা হচ্ছে, এবার কৃষকেরা শিলাবৃষ্টিতে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মোট ফসলের তুলনায় এটা খুব কম। আর যদি ঝড় ও শিলাবৃষ্টি না হয়, তাহলে এক সপ্তাহ পর থেকে কৃষকেরা তাঁদের স্বপ্নের ফসল ঘরে তুলতে পারবেন।