অগ্নিনিরাপত্তা নেই আরডিএ মার্কেটে

রাজশাহী নগরের সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা সাহেব বাজার। এর প্রাণকেন্দ্রেই অবস্থিত আরডিএ মার্কেট। এখানে প্রায় আড়াই হাজার দোকান রয়েছে। সারা দিনে কয়েক হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। এমন গুরুত্বপূর্ণ বিপণিবিতান নির্মাণ করা হয়েছে বিল্ডিং কোড অমান্য করে। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সুপারিশও দেয়, কিন্তু তা মানা হয়নি। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স বলছে, এই বিপণিবিতানের অগ্নিনিরাপত্তা নেই।

রাজশাহী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, গতকাল সোমবার সকালে আরডিএ মার্কেটের দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির বাঁ পাশে একটি ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছেন। তাতে লিখে দিয়েছেন, ‘আরডিএ মার্কেট অগ্নিনির্বাপণের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ।’ তিনি বলেন, একইভাবে তাঁরা রাজশাহী নিউমার্কেটেও এই ব্যানার টানিয়ে দিয়েছেন।

রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৬-৮৭ সালের দিকে এখানে টিনশেড মার্কেট তৈরি করা হয়েছিল। ২০০৪ সালে ওই জায়গায় আরডিএর পুনর্বাসিত ব্যবসায়ী সমিতিকে দিয়ে পর্যায়ক্রমে সামনের অংশ তিনতলা ও পেছনের অংশ চারতলা করা হয়। আগের টিনশেড মার্কেটের মধ্য দিয়ে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য জায়গা রাখা ছিল। এখন আড়াই হাজার দোকানের জন্য সামনে একটু অ্যাপ্রোচ সড়ক ছাড়া গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। এই বিপণিবিতানের সামনে সারা দিন যানজট লেগে থাকে।

আরডিএ সূত্রে জানা গেছে, বিল্ডিং কোড অনুযায়ী, এ ধরনের বাণিজ্যিক ভবনের প্রায় ২০ শতাংশ পার্কিং ব্যবস্থা থাকার কথা। সেই হিসাবে এই নতুন ভবনের বেসমেন্টের পুরোটাই পার্কিংয়ের জন্য রাখার কথা। কিন্তু ভবনের নকশায় বেসমেন্টের মাত্র ৪০ শতাংশ পার্কিংয়ের জন্য রাখা হয়েছে। জানা গেছে, ভবনের নকশা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অনুমোদন করেননি। অভিযোগ রয়েছে, আরডিএর তৎকালীন চেয়ারম্যান তপন চন্দ্র মজুমদার নিজেই অনুমোদন করেন।

এ ছাড়া বিপণিবিতানের ভবন দুটির মাটির ভার বহনের ক্ষমতার সঙ্গে নকশা সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা যাচাইয়ের জন্য আরডিএর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুর রহিম গত বছর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী সিরাজুম মুনীরের নেতৃত্বাধীন এই কমিটি ২০১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে নানা অসংগতির কথা উল্লেখ করা হয়। আর পেছনের ভবনের নকশায় মাটি পরীক্ষার কোনো সূত্র তদন্ত কমিটি খুঁজে পায়নি। এসব অসংগতির কথা তুলে ধরে তদন্ত প্রতিবেদনে এই ভবনের কাঠামো পুনঃপরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়। সেই সঙ্গে বলা হয়েছে, জনগুরুত্বপূর্ণ জনসমাবেশস্থল হিসেবে এই ভবন বিল্ডিং কোড অনুসারে নির্মিত হওয়া আবশ্যক।

বিপণিবিতানে নিয়মিত কেনাকাটা করেন রাজশাহী নগরের কালু মিস্ত্রির মোড়ের গৃহবধূ আলিয়া রূপি। তিনি বলেন, মার্কেটের ভেতরে ঢুকলে দম বন্ধ হয়ে আসে। এই মার্কেটে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষকে উদ্ধারের কোনো পথ পাওয়া যাবে না। বিপণিবিতানের কয়েকজন দোকানি বলেন, তাঁরা এটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণের বিপক্ষে।

বিপণিবিতান পরিচালনা কমিটির উপদেষ্টা সেকেন্দার আলী অপরিকল্পিতভাবে মার্কেটটি গড়ে তোলার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, মার্কেটের ভেতরে অক্সিজেন কম। অনেক দিন ধরে যাঁরা এখানে ব্যবসা করে আসছেন, তাঁদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁরা এ নিয়ে ভাবছেন। কয়েকবার আরডিএ এবং ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে তাঁদের বৈঠক হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস কিছু অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম দিয়েছিল, সেগুলোরও বোধ হয় মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।

সেকেন্দার আলী বলেন, এটা একটা ঘিঞ্জি মার্কেট হয়ে গেছে। এটাকে আধুনিক ও নিরাপদ করে নতুনভাবে গড়ে তোলার কথা বলতে গেলেই সাধারণ ব্যবসায়ীরা ভয় পান। তাঁরা মনে করেন, ভাঙলেই তাঁদের ‘পজেশন’ হারাবেন। এখন সবাইকে বুঝিয়ে একটা আস্থার জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। আরডিএ এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বসে এমন একটা সিদ্ধান্তে তাঁরা আসতে চান, যাতে কারও ক্ষতি না হয় এবং মার্কেটটাও একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আসে।

রাজশাহী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা শাহীদুল ইসলাম বলেন, আরডিএ মার্কেটের অগ্নিনিরাপত্তা নেই। এর আন্ডারগ্রাউন্ডে জলাধার নেই। আশপাশে পুকুরও নেই। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকানোর মতো প্রশস্ত রাস্তা নেই। সাধারণত এত বড় বাণিজ্যিক ভবনগুলোর পাশে অন্তত ৩০ ফুট চওড়া রাস্তা রাখা দরকার। এই মার্কেটের পাশে ১৩-১৪ ফুট রাস্তা ছাড়া হয়েছে। জরুরি অবস্থায় মার্কেট থেকে বের হওয়ার জন্য বিকল্প সিঁড়ি থাকতে হয়, তা–ও এখানে নেই। ভেতরে ৩২টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার রয়েছে। অন্যান্য ব্যবস্থা না করে শুধু এগুলো দিয়ে জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করা যাবে না।

আরডিএর চেয়ারম্যান বজলুর রহমান বলেন, ‘আরডিএ মার্কেট নিয়ে কিচ্ছু বলার নেই। অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই। আমি বাংলাদেশের অন্যতম প্রকৌশলীকে দিয়ে ১৫ তলাবিশিষ্ট একটি পরিকল্পিত ভবন তৈরির জন্য নকশা তৈরি করেছিলাম। কিন্তু আরডিএ মার্কেটের আড়াই হাজার দোকানের ১০ হাজার কর্মচারী আছে। তাদের আগে পুনর্বাসন করতে হবে। সেটাই করা যাচ্ছে না।’

বজলুর রহমান আরও বলেন, শহরের ঢাকা বাস টার্মিনাল এলাকায় আরডিএর ১৩ বিঘা জমি আছে। টার্মিনালটা সরিয়ে সেখানে বহুতল ভবন করে ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন করা যায়। কিন্তু তা করতে অন্তত দুই বছর সময় লাগবে। আর ব্যবসায়ীরা তাতে রাজি হবেন কি না, সেটা নিয়েও ভাববার বিষয়। এ বিষয়ে মেয়রের সহযোগিতাও লাগবে।