অগ্নিদুর্ঘটনা ঠেকাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা

অগ্নিদুর্ঘটনা ঠেকাতে স্থাপন করা হয়েছে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র। সম্প্রতি কড়াইল বস্তির ক ব্লকের বউ বাজারে।  ছবি: সাজিদ হোসেন
অগ্নিদুর্ঘটনা ঠেকাতে স্থাপন করা হয়েছে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র। সম্প্রতি কড়াইল বস্তির ক ব্লকের বউ বাজারে। ছবি: সাজিদ হোসেন

হুট করে আগুন লেগে যায় কড়াইল বস্তির একটি ঘরে। দ্রুতই খবর ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসেন কয়েক তরুণ। হাতে ফায়ার এক্সটিংগুইশার (অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র)। পুড়তে থাকা ঘরটির বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলেন। কয়েকজনের তাৎক্ষণিক উদ্যোগের ফলে গত বুধবার সন্ধ্যায় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড থেকে রক্ষা পায় কড়াইল বস্তি।

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, কড়াইল বস্তিতে প্রায় ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটে। স্বেচ্ছাসেবীদের তৎপরতার কারণে এসব দুর্ঘটনা মারাত্মক হয়ে ওঠে না, অল্পতেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাদের এমন তৎপরতার কারণে বেশ কয়েক মাস ধরে স্বস্তিতে রয়েছেন বাসিন্দারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত মাসে অন্তত ১৮টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে এই বস্তিতে। এর মধ্যে তিনটি আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতা লেগেছে। বাকি ১৫টি স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরাই নিভিয়ে ফেলেছেন।

এই স্বেচ্ছাসেবী দলের যাত্রা শুরু হয়েছে ৯ মাস আগে। তাদের সদস্য ৪০ জন। যাত্রা শুরুর পর থেকেই বস্তিতে প্রতি মাসেই একবার মহড়া দিচ্ছে দলটি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ওয়ার্ল্ড ভিশনের সহযোগিতায় তাদের অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে তেজগাঁও ফায়ার সার্ভিস।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বউবাজার এলাকায় মন্টু মিয়ার বাসার সামনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। মন্টু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, আগুন লাগার ১০ মিনিটের মধ্যেই স্বেচ্ছাসেবীরা এসে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তাঁরা অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন নেভান। ফায়ার সার্ভিসকে আর খবর দিতে হয়নি। অবশ্য ওই দিনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বস্তির দুই ব্যক্তি দগ্ধ হয়েছিলেন।

স্থানীয় আবদুল গাফফার বলেন, ‘বস্তিতে প্রায়ই আগুন লাগে। এতে সব সময় একটা আতঙ্ক কাজ করে। তবে স্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করার পর থেকেই অনেকটা স্বস্তিতে আছি। কারণ, ইতিমধ্যে তাঁরা বেশ কয়েকটি আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছেন। পাশাপাশি বাসিন্দাদের মধ্যে সচেতনাও বাড়িয়েছেন।’

বাসিন্দারা বলেন, কড়াইল বস্তিতে আগে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। প্রায়ই ঘটত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ২০০৪ সালে এনজিও দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের (ডিএসকে) উদ্যোগে বস্তিতে কড়াইল সেন্ট্রাল সিবিও (কমিউনিটি বেসড অর্গানাইজেশন) কমিটি করা হয়। এই কমিটিই এখন কড়াইল বস্তির সবকিছুর দেখভাল করছেন। বর্তমানে কমিটির সভাপতি স্থানীয় সেলিনা আক্তার ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান।

আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, কমিটির সম্মতিতেই ৯ মাস আগে ওয়ার্ল্ড ভিশনের সহযোগিতায় তাঁরা একটি স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করেন। তাঁকেই দলনেতা করা হয়। স্বেচ্ছাসেবীরা সবাই বস্তির বাসিন্দা। সদস্যসংখ্যা বাড়াতে ১৫ এপ্রিল আরও ৬০ জনকে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কড়াইল বস্তিতে ২০০ স্বেচ্ছাসেবী থাকাটা যথেষ্ট বলেও মনে করেন তিনি।

ডিএসকে সূত্রে জানা যায়, কড়াইল বস্তি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৯ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে। এর মধ্যে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে প্রায় ২২ হাজার পরিবার বসবাস করে। আর ২০ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে ছয় থেকে সাত হাজার পরিবারের বাস। দুটি ওয়ার্ড মিলিয়ে বস্তিতে লোকসংখ্যা এক লাখের বেশি হবে। স্বেচ্ছাসেবীরা জানান, ৯ মাস আগে কড়াইল বস্তিতে ৯৪০টি ফায়ার ডিটেক্টর অ্যালার্ম (আগুন লাগলে হর্ন বেজে ওঠার যন্ত্র) বিতরণ করেছে ওয়ার্ল্ড ভিশন। একটি অ্যালার্ম বেজে উঠলে আশপাশে থাকা সব একসঙ্গে বেজে ওঠে। পাশাপাশি ৪৯টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার বিতরণ করা হয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ভিশনের কর্মকর্তা ফাতেমা মেহেরুন নেছা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরীক্ষামূলক প্রকল্পের অংশ হিসেবে আমরা এসব যন্ত্র বিতরণ করেছি। আগুন নেভানোর জন্য কয়েকজনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। প্রাথমিকভাবে আগুন নেভাতে যেসব যন্ত্রের প্রয়োজন হয়, তাও সরবরাহ করেছি। নতুন করে প্রকল্প অনুমোদন হলে আরও যন্ত্রপাতি বিতরণ করা হবে।’

সরেজমিন কড়াইল বস্তির বউবাজার এলাকায় বেশ কয়েকটি বাসা বাড়িতে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র দেখা গেছে। যন্ত্রটি থাকার কারণে বাসিন্দাদের অনেকে একধরনের স্বস্তিতে আছে। তাদের মধ্যে জুয়েল হাওলাদার নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘কাজের কারণে প্রায়ই তিনি ঘরের বাইরে থাকেন। আগুন লাগলেই হর্ন বেজে উঠবে, এ জন্য একটু নিশ্চিন্তে থাকি।’ প্রতি মাসেই তাঁদের এলাকায় মহড়া হয় বলেও জানান তিনি।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক কড়াইল বস্তিতে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র বিতরণের পরিকল্পনা করছে। প্রতিষ্ঠানটির ফিল্ড কো–অর্ডিনেটর শাহিনুর রহমান বলেন, কড়াইল বস্তির বিভিন্ন এলাকাতে আগামী মাসেই তাঁরা ২০০টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার, ৫০০টি ফায়ার ডিটেক্টর অ্যালার্ম ও ২০০টি অটোমেটিক ফায়ার অফ যন্ত্র বিতরণ করবেন। স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন বলে জানান তিনি।

২০১৭ সালের ১৫ মার্চ রাতে কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৫ হাজার ৬০০ ঘর পুড়ে গিয়েছিল। এর আগে ২০১৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাতে অগ্নিকাণ্ডে পুড়েছে ৩ হাজার ৬০০ ঘর। স্বেচ্ছাসেবীদের তৎপরতায় ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটলেও তা বড় আকার ধারণ করছে না বলে মনে করেন বস্তির বাসিন্দারা।