এবার ব্রি-২৮ চাষে মাথায় হাত
>
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা বলছেন, খেতের বেশির ভাগ ধানের ভেতর চালের বদলে চিটা পড়েছে। বীজে কোনো সমস্যার কারণে এটা হতে পারে।
উচ্চফলনশীল। আবার আগাম উঠে যায়। এই দুই কারণে ব্রি-২৮ জাত বেশ জনপ্রিয়। তবে এবার এই জাতের ধান চাষ করে লোকসানে পড়েছেন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার অনেক কৃষক।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা বলছেন, খেতের বেশির ভাগ ধানের ভেতর চালের বদলে চিটা পড়েছে। বীজে কোনো সমস্যার কারণে এটা হতে পারে। তবে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, যাঁরা আগেভাগে এই ধান লাগিয়েছেন, কেবল তাঁরাই ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শওকত ওসমান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ঠান্ডাজনিত কারণ ও সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় ব্রি-২৮ ধান এবার কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছর এই জাতের ধানে ব্লাস্টরোগ দেখা দিয়েছিল। ফলে এবার এই জাতের ধানের আবাদ তুলনামূলক অনেক কম হয়েছে। তিনি বলেন, কৃষি বিভাগের তৎপরতায় এবার বেশির ভাগ কৃষকের খেতেই ব্রি-২৮ জাতের ধান ভালো হয়েছে। কিন্তু যেসব কৃষক অগ্রহায়ণ মাসে ব্রি-২৮ রোপণ করেন, তাঁরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কারণ, এই ধান রোপণের উপযুক্ত সময় হচ্ছে পৌষ মাস। তবে ব্রি-২৮ ধান কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা এখনো নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানান এই কর্মকর্তা।
উপজেলার নলুয়া, মইয়া ও পিংলার হাওরে ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাওরের কৃষকেরা সব সময়ই অকালবন্যার আতঙ্কে থাকেন। এ কারণে কৃষকেরা সাধারণ আগাম জাতের ধানের দিকে ঝুঁকে থাকেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের সামনে কয়েকটি দেশীয় জাতের ধান রয়েছে। কিন্তু এসব জাতের ধানের ফলন তুলনামূলক কম হয়। এ কারণে কৃষকেরা উচ্চফলনশীল জাতের ধান চাষ করে থাকেন। কিন্তু উচ্চফলনশীল জাতের বেশির ভাগ ধানই দেরিতে ঘরে ওঠে। তবে তুলনামূলকভাবে আগে ব্রি-২৮ ধান। ফলে উচ্চফলনশীল জাতগুলোর মধ্যে ব্রি-২৮-ই বেশি জনপ্রিয়। গত গত কয়েক বছর ধরে কৃষকেরা এই জাতের ধান চাষ করে যেমন ভালো ফলন পেয়ে আসছেন, তেমনি আগাম ঘরেও তুলতে পারছেন। কিন্তু গত বছর হাওরের কিছু এলাকায় ব্রি-২৮ ধানে ব্লাস্টরোগ দেখা দেয়। আর এবার অনেক কৃষকের খেতে এই জাতের ধান চিটা হয়ে গেছে। ফলে কৃষক কাঙ্ক্ষিত ফলন পাচ্ছেন না।
গত শনিবার হাওর ঘুরে দেখা গেছে, হাওরে সোনালি ফসলে ভরপুর। কিছু কিছু জমির ধান কৃষিশ্রমিকেরা কাটা শুরু করেছেন। কেউ বা খেতের ফসল কবে কাটতে পারবেন তা যাচাই করে দেখছেন। জমির সোনালি ফসল দেখে আনন্দিত অনেক কৃষক। তবে যেসব কৃষকের খেতের ধানে চিটা দেখা দিয়েছে, তাঁদের চোখেমুখে হতাশার ছাপ।
মইয়ার হাওরে কথা হয় উপজেলার যাত্রাপাশা গ্রামের কৃষক বকুল গোপের সঙ্গে। তিনি নিজের জমিতে ব্রি-২৮ ধান দেখিয়ে বললেন, ‘এবার আমি পাঁচ কেদার (৩০ শতকে এক কেদার) জমিতে ধানের আবাদ করেছি। তার মধ্যে দুই কেদারে লাগিয়েছিলাম ব্রি-২৮ ধান। এই দুই কেদার জমিতে ধান পাইনি বললেই চলে। বেশির ভাগ ধানে চালের বদলে ছোঁচা (চিটা) দেখা যাচ্ছে।’ বকুল গোপের এই দুই কেদার জমিতে খরচ হয়েছে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা। এখন পাঁচ মণ ধানও পাবেন না বলে জানান তিনি। অথচ ঠিকমতো ফলন হলে এখানে তাঁর ধান পাওয়ার কথা ছিল অন্ত ৩০ মণ। কপাল ভালো হলে আরও বেশি।
একইভাবে নলুয়ার হাওরের কৃষক শরিফুল মিয়া ইতিমধ্যে সাড়ে চার কেদার জমির ব্রি-২৮ জাতের ধান মাড়াই দিয়েছেন। ধান পেয়েছেন মাত্র ১১ মণ। গত বছর একই জমি থেকে তিনি ধান পেয়েছিলেন ৬০ মণ। এই কৃষকের ধারণা, এবার ব্রি-২৮ ধানের বীজে কোনো ধরনের ত্রুটি ছিল। এ কারণেই এবার এই ধানে চিটা পড়েছে বেশি।
ভূরাখালি গ্রামের কৃষক কয়েছ মিয়া বলেন, ব্রি-২৮ ধান উচ্চফলনশীল ও আগাম জাতের। ফলে হাওর অঞ্চলে দ্রুত জনপ্রিয়তা পায় এই ধান। এবারে এ ধানে ফলন বিপর্যয় হওয়ায় কৃষকদের মাথায় হাত উঠছে।
কয়েছসহ নলুয়ার হাওরের আরও কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্রি-২৮ ধান চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পেকে যায়। কেদারপ্রতি ১৫ থেকে ২০ মণ ধান পাওয়া যায়। এবার জগন্নাথপুর উপজেলায় মোট ২০ হাজার ৭২৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। তার মধ্য ৩৫০০ হেক্টর জমিতে ব্রি-২৮ আবাদ করা হয়েছে। এ তথ্য জগন্নাথপুর উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের।
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা লুৎফুর রহমান বলেন, কৃষকেরা অনেক কষ্ট ও অর্থ ব্যয় করে ধান চাষ করেন। প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ফসল ঘরে তোলেন তাঁরা। কাঙ্ক্ষিত ফলন ও ধানের ন্যায্য দাম না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ছেন কৃষকেরা। ব্রি-২৮ ধান জগন্নাথপুরের কৃষকদের হতাশ করে দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বিষয়টি কৃষি বিভাগের তদন্ত করে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো দরকার।