একে একে ভরাট হচ্ছে বগুড়ার সব পুকুর

বগুড়া শহরের মালতীনগরের সাহেববাজার এলাকায় সাড়ে সাত বিঘার একটি পুকুর ছিল। ভরাট হতে হতে এখন তা বিঘা চারেকে দাঁড়িয়েছে। ভরাট অব্যাহত রয়েছে। ছয় মাস আগে এই পুকুরের উত্তর পাশ ভরাট করে ১৬ শতাংশ জমি বিক্রিও করা হয়েছে। এখন ভরাট হচ্ছে পুকুরের আরেক পাশ। সেখানে চার শতক জমি কেনার জন্য একজন বায়না করেছেন। পুকুরমালিকেরা জানিয়েছেন, এই পুকুরের পুরোটাই ভরাট করে বিক্রি করা হবে।

কেবল এই পুকুর নয়, বগুড়া শহরে এখনো যেসব পুকুর রয়েছে, তার অধিকাংশই ভরাট করা হচ্ছে। পুকুর ভরাট করে কোথাও পাকা বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে, কোথাও তৈরি করা হয়েছে বিপণিবিতান। বগুড়ার প্রবীণ ব্যক্তিদের কয়েকজন জানিয়েছেন, ১০ বছরে ভরাট হয়ে গেছে অর্ধশতাধিক পুকুর ও জলাশয়।

প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ অনুযায়ী পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি। কোনো ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করলে আইনের ৮ ও ১২ ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বগুড়া কার্যালয় জানিয়েছে, বগুড়ায় ক্রমাগত পুকুর ভরাটের কারণে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হবে। এ কারণে সংস্থাটি বগুড়া পৌর এলাকার ৯২টি পুকুরের তালিকা তৈরি করেছে। এসব পুকুর ভরাট বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বগুড়া পৌরসভাকে তারা লিখিতভাবে জানিয়েছে।

এই তালিকা ও তালিকার বাইরে থাকা বগুড়া শহরের ১৫টি পুকুর ঘুরে ভরাটের বিভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। শহরের মালতীনগরের স্টাফ কোয়ার্টারের পুকুর ভরাট হয়েছে বছর দশেক হলো। মালতীনগরের পাশেই চকমালগ্রাম এলাকার একটি পুকুরে চারপাশ থেকে ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। পুকুরের পানিও তলানিতে ঠেকেছে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের বগুড়া কার্যালয়ের মধ্যে প্রায় আড়াই বিঘা আয়তনের একটি পুকুর ছিল। এটি এখন ১২ থেকে ১৫ শতকে দাঁড়িয়েছে। পুকুরটি ভরাট করে ফুলের বাগান করছে বগুড়া সওজ। সংস্থাটির নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান বলেছেন, বিভিন্ন প্রয়োজনে পুকুরটি ভরা করা হয়েছে। এখন পুকুরের যে অংশটুকু আছে, তা বাঁধাইয়ের চেষ্টা হচ্ছে। যেন আর ভরাট না হয়।

শহরের ঝাউতলা এলাকা ও আশপাশে বিভিন্ন রাসায়নিকের দোকান ও গুদাম রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের মতে, এলাকাটি অগ্নিকাণ্ডের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। আর এই এলাকার একটি পুকুরের পশ্চিম দিকের অংশ ভরাট করে বাড়ি করা হয়েছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, কিছুদিন আগে এই পুকুরের অর্ধেক ভরাট করা হয়েছে। এখানে বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে।

শহরের মালগ্রাম মৌজার সাড়ে চার বিঘা আয়তনের একটি পুকুর এখন ‘প্লট আকারে’ বিক্রি করা হচ্ছে। পুকুরের মালিকেরা বলছেন, টাকার প্রয়োজনে বিক্রি করা হচ্ছে। শহরের কামারগাড়ি এলাকায় রয়েছে দুটি পুকুর। তার একটি ভরাট করে বিপণিবিতান নির্মাণ করা হয়েছে। আরেকটিরও আংশিক ভরাট করা হয়েছে। এমনকি বগুড়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ের মধ্যকার পুকুরও ভরাট হয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা বজলুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, স্টেশনের ভেতরে পানির সংরক্ষণাগার থাকার কারণে পুকুরের পানি প্রয়োজন হয় না। তবে শহরের অন্য পুকুরগুলো রক্ষা করা না গেলে অগ্নিনির্বাপণ কষ্টকর হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা (সংশোধিত), ২০১০ অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণ ছাড়া জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গা ভরাট বা অন্য কোনোভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। পুকুর ভরাট দণ্ডনীয় অপরাধ।

বগুড়ায় ক্রমাগত পুকুর ভরাট সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক আশরাফুজ্জামান বলেন, বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। লোকবলসংকটের কারণে সব বিষয় জানা যায় না। তবে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ক্রমাগত পুকুর ভরাটের কারণে শহরের অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় কয়েক বছর আগে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আগুন লাগলে নেভানোর জন্য পানি পাওয়া যায় না, এই কারণে শহরে পাঁচটি ভূগর্ভে পানি সংরক্ষণাগার করা হবে। এর মধ্যে সাতমার সপ্তপদী মার্কেটের নিচে একটি, শ্যামলী হোটেলের নিচে একটি, কাঁঠালতলী এলাকায় একটি, দত্তবাড়ি ও শহরের জলেশ্বরীতলায় একটি। এর মধ্যে একাধিক জেলা প্রশাসক এসেছেন, আবার চলেও গেছেন, কিন্তু রিজার্ভার হয়নি। একই পরামর্শ পৌরসভাকেও দেয় ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহাম্মদ বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস প্রস্তাব তাদের বিভাগে পাঠাতে পারে। আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো প্রস্তাব এলে আমরা সহযোগিতা করব। কোনো বরাদ্দ এলে দেখা হবে। এই বরাদ্দ ফায়ার সার্ভিস থেকেই আসতে হবে। এ ধরনের কোনো বরাদ্দ জেলা প্রশাসনে নেই। বগুড়া পৌরসভাকে বলেছি, অগ্নিনির্বাপণের জন্য অন্ততপক্ষে ফায়ার হাইড্রেন্ট রাখা যেতে পারে।’

পৌরসভার মেয়র এ কে এম মাহবুবর রহমান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পুকুরের একটি তালিকা করা হয়েছে। মালিকদের চিঠি দেওয়া হচ্ছে। কেউ পুকুর ভরাট করতে চাইলে বিধান মেনে করতে হবে।