কোটি কেজি চা উৎপাদনের আশা

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষ বাইরে থেকে চা এনে পান করতেন। সবাই ভাবতেন, উঁচু ও পাহাড়ি এলাকায়ই চা উৎপাদন করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশ চা বোর্ড এই প্রচলিত ধারণা বদলে দিয়েছে। তাই তো এই দুই জেলার সমতল ভূমিতে চা–চাষ হচ্ছে। এই জেলার মানুষ চা আমদানি নয়, বরং জেলার বাইরে পাঠাচ্ছে।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মার্চ থেকে নভেম্বর মাস চা উৎপাদনের মৌসুম। কয়েক বছর ধরে প্রতি মৌসুমে পর্যায়ক্রমে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে। চা বোর্ডের নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড় এবং এর পাশের ঠাকুরগাঁও জেলায় ২০১৮ সালের চায়ের মৌসুমে মোট ৮৪ লাখ ৬৭ হাজার কেজি চা উৎপাদন করা হয়েছিল। এবার চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৯৫ লাখ কেজি নির্ধারণ করা হলেও তা ১ কোটি কেজি ছাড়িয়ে যাবে।

উত্তরাঞ্চলে চা–চাষ সম্প্রসারণ এবং চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ চা বোর্ড নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের কাজ শুরু করে। এই প্রকল্প ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত চলবে। চা–চাষিদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান, স্বল্পমূল্যে উচ্চ ফলনশীল ও গুণগত মানসম্পন্ন বিটি সিরিজের চারা সরবরাহ এবং নতুন করে চা–চাষে উদ্বুদ্ধকরণের জন্য এই প্রকল্পকে ৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।

 বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পঞ্চগড় জেলায় ২০০০ সালে চা–চাষ শুরু হয়। গত এক দশকের হিসাব অনুযায়ী ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে চায়ের চাষ সাড়ে ৩ গুণ বেড়েছে। ওই সময়ের চায়ের উৎপাদন বেড়েছে ১৩ গুণ। নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত মোট ৭ হাজার ৬৪৫ একর জমিতে চা–চাষ হয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চগড় জেলায় জেলায় মোট চা–চাষ হয়েছে ৬ হাজার ৭৯২ একর জমিতে। যার মধ্যে নিবন্ধিত চা–বাগান ৭টি এবং অনিবন্ধিত রয়েছে ১৮টি। নিবন্ধিত ক্ষুদ্র চা–বাগান ১৫টি এবং অনিবন্ধিত ২টি। এ ছাড়া ক্ষুদ্র চা–চাষির সংখ্যা (শূন্য থেকে ৫ একর) নিবন্ধিত ৬১৮ জন এবং অনিবন্ধিত ৩ হাজার ১৯০ জন।

নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের প্রকল্পের আওতায় পাশের ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় মোট ৭৪১ একর জমিতে চাষ হয়েছে। সেখানে বাগান পর্যায়ে ১টি নিবন্ধিত ও ১টি অনিবন্ধিত চা–বাগান রয়েছে। এ ছাড়া অনিবন্ধিত ক্ষুদ্র চা–বাগান একটি এবং নিবন্ধিত ক্ষুদ্র চা–চাষি ৩০৬ জন ও অনিবন্ধিত ২০০ জন। এ ছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় নীলফামারী, লালমনিরহাট ও দিনাজপুর জেলায় চা–চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে।

পঞ্চগড় জেলায় ১২টি, ঠাকুরগাঁও জেলায় একটিসহ মোট ১৩টি চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় চা–পাতা থেকে চা উৎপাদন করা হয়। এই কারখানাগুলো চা-চাষিদের কাছ থেকে সবুজ চা–পাতা প্রতি কেজি ২৪ টাকা ৫০ পয়সা দরে কিনে তা থেকে চা উৎপাদন করা হয়। পঞ্চগড়ে উৎপাদিত এই চা চট্টগ্রামে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করেন চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মালিকেরা। তবে চাহিদা অনুযায়ী এই কাঁচা পাতার দাম মাঝেমধ্যে বেড়ে যায়।

চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্র আরও জানায়, পঞ্চগড়ে ২০১৪ সালে চা উৎপাদিত হয়েছে ১৪ লাখ ২০ হাজার ৪৬৭ কেজি, ২০১৫ সালে ২৫ লাখ ২১ হাজার ৯২১ কেজি, ২০১৬ সালে ৩২ লাখ ৬ হাজার কেজি, ২০১৭ সালে ৫৪ লাখ ৪৬ হাজার কেজি ও ২০১৮ সালে ৮৪ লাখ ৬৭ হাজার কেজি।

পঞ্চগড় সদর উপজেলার মহারাজার দীঘি এলাকার চা–চাষি সায়েদ আলী বলেন, ‘আমি পাঁচ একর জমিতে চা–চাষ করেছি। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার চা–পাতার উৎপাদন বেশি। প্রতি মৌসুমে আমরা সাতবার (৪০ দিনে এক রাউন্ড) চা–পাতা সংগ্রহ করতে পারি। গত বছর আমরা প্রতিবার প্রতি একরে চা–পাতা পেয়েছি ২ হাজার থেকে ২ হাজার ১০০ কেজি। আর এবার প্রতি রাউন্ডে প্রতি একরে চা–পাতা পাচ্ছি প্রায় ৩ হাজার কেজি। তবে সরকারি মূল্য প্রতি কেজি ২৪ টাকা ৫০ পয়সা হলেও চাহিদা বেশি হওয়ায় আমি প্রতি কেজি চা–পাতা ৩১ টাকা দরে বিক্রি করেছি। আশা করছি গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার অনেক বেশি চা–পাতা সংগ্রহ করতে পারব।’

পঞ্চগড় নর্থবেঙ্গল সেন্ট্রাল টি কারখানার ব্যবস্থাপক আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা চা–চাষিদের কাছ থেকে কাঁচা চা–পাতা নির্ধারিত দামে কিনি। পরে আমাদের কারখানায় উৎপাদিত তৈরি চা চট্টগ্রাম নিলাম বাজারে (অকশন মার্কেটে) মান অনুযায়ী বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন কোম্পানি তা কিনে তাদের নামে বাজারজাত করে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার চায়ের উৎপাদন বেশি হবে বলে মনে হচ্ছে।’

বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, ‘চায়ের চাষ সম্প্রসারণের জন্য আমরা চাষিদের বিভিন্ন সহায়তার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এর মধ্যে চা–চাষিদের নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় মাসে চারটি কর্মশালা হচ্ছে। সব সময়ই চা–চাষিদের বিটি সিরিজের (বাংলাদেশি প্রযুক্তির) ক্লোন বা চায়ের চারা রোপণের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। এতে উৎপাদন আরও ভালো হবে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার চায়ের উৎপাদন উত্তরবঙ্গে সর্বোচ্চ রেকর্ড করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের বাইরেও চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ে একটি চা পরীক্ষণাগার স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে চা–চাষিদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান, চাষের নানা রোগবালাই ও পোকা দমনে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সহায়তা দেওয়া হয়।