পোস্টারে ঢাকা 'আসাদ গেট' তোরণ

পোস্টার লাগানোর স্থানগুলো এভাবেই ফাঁকা পড়ে থাকে। সম্প্রতি আসাদগেট এলাকায়।  প্রথম আলো
পোস্টার লাগানোর স্থানগুলো এভাবেই ফাঁকা পড়ে থাকে। সম্প্রতি আসাদগেট এলাকায়। প্রথম আলো

সাল উনিশ শ উনসত্তর। পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল ছাত্র-জনতা। এর মধ্যেই পুলিশের গুলিতে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান—এ ঘটনা আন্দোলনের চেহারাই পাল্টে দেয়। সেই বেগবান আন্দোলন রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে।

শহীদ আসাদের স্মৃতি সমুজ্জ্বল রাখতে মোহাম্মদপুর এলাকার একটি তোরণের নামকরণ করা হয় আসাদ গেট। তোরণটি এখনো আছে, কিন্তু পোস্টারে ঢাকা পড়েছে এর সৌন্দর্য। অথচ এই তোরণে পোস্টার সাঁটানো যে দণ্ডনীয় অপরাধ, তা স্পষ্ট করেই লেখা আছে সেখানে। শুধু এই তোরণ নয়, মহানগরীর বহু প্রত্ননিদর্শন, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, সরকারি, বেসরকারি ভবনের দেয়াল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাসস্ট্যান্ড, উড়ালসড়কে, রেলস্টেশন, এমনকি যানবাহনের গায়েও নির্বিচারে লাগানো হচ্ছে হরেক রকম পোস্টার। কিন্তু সিটি করপোরেশন থেকে পোস্টার লাগানোর নির্ধারিত স্থান ফাঁকা পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

এমন দৃষ্টিকটুভাবে যত্রতত্র পোস্টার সাঁটানো বন্ধ করতে ২০১২ সালে একটি আইন করা হয়েছিল। নাম ‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন’। আইনটি কাগজে-কলমেই আছে, বাস্তবে প্রয়োগ নেই। আইন অনুযায়ী, ঢাকা শহরে সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থান ছাড়া বাসস্থান, অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাকেন্দ্র, শিল্পকারখানা, দোকান বা অন্য কোনো স্থাপনার দেয়াল, গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, খাম্বা, সড়কদ্বীপ, সড়ক বিভাজক, ব্রিজ, কালভার্ট, সড়কের উপরিভাগ ও বাড়ির ছাদ, যানবাহনে লেখালেখি বা পোস্টার সাঁটানো যাবে না। আইন অমান্য করলে ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অনাদায়ে ১৫ দিন থেকে এক মাসের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

ঢাকা শহরে আইনটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের। কিন্তু দুই সিটি করপোরেশনের অনেক কর্মকর্তাই আইনটি কার্যকর কি না, তা নিয়েই সন্দিহান। কারণ, আইনটির শুরুতে বলা আছে, ‘সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, যে তারিখ নির্ধারণ করিবে সেই তারিখে ইহা কার্যকর হইবে।’ শেষ পর্যন্ত গেজেট হয়েছিল কি না জানতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির দুই আইন কর্মকর্তা ও একজন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাঁরা কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি, আইনটি কার্যকর করতে গেজেট হয়েছিল কি না। তবে ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাজিদ আনোয়ার নিশ্চিত করেছেন, আইনটি পাসের পর গেজেট করে তা কার্যকর করা হয়েছে।

যত্রতত্র পোস্টার লাগানো বন্ধ করতে রাজধানীর কিছু স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে সিটি করপোরেশন। আইনগত পদক্ষেপ না নেওয়ায় ওই নির্ধারিত স্থানগুলো ফাঁকাই থাকে। সম্প্রতি একাধিকবার আসাদ গেটে গিয়ে দেখা গেছে, তোরণটি থেকে কয়েক হাত দূরেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) একটি ‘স্ট্যান্ড’ আছে। ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের উদ্যোগে স্ট্যান্ডগুলো বসানো হয়েছে। স্ট্যান্ডটিতে পোস্টার লাগানোর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে বলে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি উল্লেখ করা আছে পোস্টার লাগানোর নিয়মও। কিন্তু গত দুই-তিন মাসে কখনোই ওই বোর্ডে একটি পোস্টারও ঝুলতে দেখা যায়নি। শুধু এই স্ট্যান্ড নয়, টাউন হলের বিপরীত পাশে, ফার্মগেট ও মিরপুরে এমন একাধিক স্ট্যান্ড দেখা গেছে। কিন্তু সব স্ট্যান্ডই ফাঁকা। কোনো স্ট্যান্ডেই পোস্টার নেই।

তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় এমন কোনো স্ট্যান্ড বা বোর্ড দেখা যায়নি। জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর জাহিদ হোসেন বলেন, ডিএসসিসিতে এমন স্ট্যান্ড বা বোর্ড নেই। তবে রাস্তায় ডিজিটাল বোর্ড আছে। তিনি বলেন, শুধু রাষ্ট্রীয় ও সরকারি অনুষ্ঠানে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় সুবিন্যস্তভাবে পোস্টার লাগানোর অনুমতি দেওয়া হয়। অন্য সময় পোস্টার লাগানোর অনুমতি দেওয়া হয় না।

সরেজমিনে ঘুরে ডিএসসিসি এলাকার প্রায় প্রতিটি উড়ালসড়কের থামে, লালবাগ কেল্লার মতো ঐতিহাসিক স্থাপনায়, পিলখানার সীমানাপ্রাচীরসহ বিভিন্ন জায়গায় অজস্র পোস্টার সাঁটানো দেখা গেছে।

এদিকে ডিএনসিসির নির্ধারিত স্থানগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর এম এ রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, যথাযথভাবে স্থান নির্ধারণ করে উত্তরা, মিরপুর, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে মোট ২০টি স্ট্যান্ড বসানো হয়েছিল। কিন্তু কেউ এগুলোতে পোস্টার লাগায় না। যত্রতত্র পোস্টার, ফেস্টুন লাগানো ও দেয়াললিখন বন্ধে ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত অভিযান চালিয়েছিল ডিএনসিসি। অভিযানে দেয়াললিখন ও পোস্টার নিয়ন্ত্রণ আইনে ৩৭টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫ লাখ ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। পাশাপাশি ৫টি কোচিং সেন্টারের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল। এরপর অবস্থার বেশ ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছিল। কিন্তু এখন আবার যত্রতত্র পোস্টার লাগানো হচ্ছে।

এম এ রাজ্জাক বলেন, যত্রতত্র পোস্টার লাগানোর বিষয়টি মেয়রকে জানানো হয়েছে। মেয়র এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। শিগগিরই যত্রতত্র পোস্টার-ব্যানারের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।