চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতায় নাকাল হবেন নগরবাসী

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতার সমস্যা এবারও দূর হচ্ছে না; বরং এই দুর্ভোগ আরও বাড়তে পারে। কারণ, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অধীনে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে যুক্ত নগরের সাতটি খালের মুখে ও ভেতরে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এসব বাঁধের কারণে বৃষ্টির পানি দ্রুত নামতে পারবে না। ফলে বর্ষায় জলাবদ্ধতা চরম আকার ধারণ করার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা।

৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ ও সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর তীরে সড়ক নির্মাণে আরেকটি প্রকল্পের কাজ চলছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) এই দুটি প্রকল্পের অধীনে নগরের সাত খালে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এসব বাঁধ দেওয়া হয়।

চলতি বছরের জলাবদ্ধতা নিয়ে সিডিএর বিদায়ী চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম তাঁর শেষ মতবিনিময় সভায়ও আশার বাণী শোনাতে পারেননি। তিনি বলেন, প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সিডিএ, সিটি করপোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রকল্প পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত জলাবদ্ধতার সমস্যা সম্পূর্ণ দূর হবে না।

খালের মধ্যে অস্থায়ী বাঁধ নিয়ে চট্টগ্রামবাসীর দুর্ভোগ নতুন নয়। জোয়ারজনিত জলাবদ্ধতা নিরসনে নগরের মহেশ খালে ২০১৫ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি অস্থায়ী বাঁধ দিয়েছিল।

খালের মুখে ও ভেতরে বাঁধ

নগরের পাথরঘাটার টেকপাড়া, কলাবাগিচা ও মরিয়ম বিবি খাল, ফিরিঙ্গিবাজারের ফিরিঙ্গিবাজার খাল, চাক্তাইয়ের চাক্তাই খাল ও রাজাখালী খালে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এগুলো কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে যুক্ত। খালগুলো দিয়ে নগরের ১১টি ওয়ার্ডের পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ে। এসব এলাকায় প্রতিবছরই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া জলকপাট (স্লুইসগেট) নির্মাণের জন্য মহেশ খালেও বাঁধ দেওয়া হয়েছে।

খাল খনন এবং দুই পাশে প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের জন্য সাময়িকভাবে এসব বাঁধ দেওয়া হয়েছে বলে জানান সিডিএর প্রকৌশলীরা। তাঁরা বলেন, খালের ভেতর থেকে পানি নদীতে নিষ্কাশনের জন্য বাঁধগুলোতে পাইপ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ২০টি খালে খননকাজ চলছে।

গত মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, চাক্তাই খালের মুখে জোয়ার প্রতিরোধক ফটকের নির্মাণকাজ চলছে। এ জন্য খালের প্রায় অর্ধেকের বেশি অংশজুড়ে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। খোলা অংশ দিয়ে পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করছে। দেশের অন্যতম বড় ভোগ্যপণ্যের বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের অবস্থান এই খালের পাশে। চাক্তাই খাল ও রাজাখালী খালের সঙ্গে যুক্ত রাজাখালী-২ খালেও বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এতে খালটিতে পানির প্রবাহ নেই।

চাক্তাই খালের পাশে অবস্থিত মরিময় বিবি খাল। নগরের পাথরঘাটা থেকে উৎপত্তি হওয়া এই খাল কর্ণফুলী নদীতে মিশেছে। মেরিনার্স রোড এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, খালের মুখে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। ভেতরের অংশ ভরাট হয়ে গেছে। এর মধ্যে খননকাজে ব্যবহৃত খননযন্ত্র চলাচল করছে। মরিয়ম বিবি খাল থেকে কয়েক শ গজ দূরেই কলাবাগিচা খাল। ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে আছে খালটি। খালের বিভিন্ন জায়গায় ঘাস ও লতা জন্মেছে। নগরের পাথরঘাটা, ইকবাল রোড, জলিলগঞ্জ এলাকার পানি এই খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কর্ণফুলী নদীতে পড়ে। কলাবাগিচা খালের পাশে টেকপাড়া খালেরও একই অবস্থা। নগরের ফিরিঙ্গিবাজারের ব্রিজঘাটা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এই এলাকায় ফিরিঙ্গিবাজার খালটিতে তিনটি বাঁধ দেওয়া হয়েছে। পাইপ দিয়ে পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে।

এসব এলাকার ১০ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, বাঁধগুলো অপসারণ করা না হলে আগামী বর্ষায় তাঁরা চরম দুর্ভোগে পড়বেন।

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ জামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি বর্ষায় জলাবদ্ধতায় ডুবে যায় চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ। খালগুলোতে বাঁধ দেওয়ায় এই দুর্ভোগ এবার আরও বাড়বে। এই আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরা গুদামে পণ্য মজুত করছেন কম।

সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপপ্রকল্প পরিচালক কাজী কাদের নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমেই খালগুলোর পাশে প্রতিরোধ দেয়ালের নির্মাণকাজ শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। এ জন্য খালগুলোর মুখে ও ভেতরে বাঁধ দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু জটিলতার কারণে এ মুহূর্তে প্রতিরোধ দেয়ালের নির্মাণকাজ শেষ হচ্ছে না। তাই বাঁধগুলো অপসারণ করা হচ্ছে।

বর্ষার আগেই অপসারণের দাবি

বর্ষার আগেই এসব বাঁধ অপসারণের দাবি জানিয়েছেন নগরের পাথরঘাটা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসমাইল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, খালগুলোতে বাঁধ দেওয়ায় জনগণ এবার কষ্ট পাবেন। প্রকল্প নিয়ে সেনাবাহিনী ও সিডিএর সঙ্গে আজ রোববারকাউন্সিলরদের বৈঠক আছে। ওই বৈঠকে বাঁধগুলো অপসারণের জন্য বলা হবে।

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান ও নগর–পরিকল্পনাবিদ দেলোয়ার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, বর্ষাকাল চট্টগ্রামবাসীর জন্য খুবই আতঙ্কের সময়। এই সময়ে খালের মুখে কোনো বাঁধ থাকলে পানিনিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলে তখন পানি আটকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। তাই বর্ষার আগেই এসব বাঁধ অপসারণ করা উচিত।