ভুলে ভরা 'নির্ভুল ও সমন্বিত তথ্য'

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার খাসকররা বাজারে গত ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল ৭টা ১৬ মিনিটে আলমসাধুর সঙ্গে দুর্ঘটনায় আবু বক্করের ছেলে আলী আজম আহত হন। স্থানীয় ব্যক্তিদের সহায়তায় সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। ১৩ মার্চ একই স্থানে ও একই সময়ে তিনি আবারও সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। এ যাত্রায়ও সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নেন তিনি।

শুধু আলী আজম একা নন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে জেলার চারটি উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ৬২ জনের মধ্যে ৪৭ জন নারী-পুরুষ মার্চ মাসেও একই ঘটনাস্থলে দ্বিতীয় দফায় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। তারা সদর হাসপাতাল ও তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছেন।

জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে ‘নির্ভুল ও সমন্বিত তথ্য’ শীর্ষকসিভিল সার্জনের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। স্বাস্থ্য বিভাগের ওই প্রতিবেদন কতটা নির্ভুল ও সমন্বিত তথ্য দিয়ে তৈরি, তা নিয়ে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রশ্ন তুলেছেন।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রতি মাসে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় নিয়মিতভাবে সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে পাঠানো সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে নির্ভুল ও সমন্বিত তথ্য উপস্থাপন করা হয়।

১৫ এপ্রিল জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় নির্ভুল ও সমন্বিত তথ্য প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। সেখানে বলা হয়, জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় মার্চ মাসে ৬৬ জন আহত হয়েছেন। এর আগে ১০ মার্চ অনুষ্ঠিত সভায় জানানো হয়েছিল, জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ফেব্রুয়ারি মাসে ৬২ জন আহত হন। প্রতিবেদন ছকে ‘নিহতের সংখ্যা ও পরিচয়’ অংশটি শূন্য দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিবেদন অনুযায়ী এই দুই মাসে জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা যাননি।

কিন্তু ওই দুই মাসে জেলায় অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১ ফেব্রুয়ারি চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়কে সদর উপজেলার জাফরপুরে ইজিবাইকের ধাক্কায় শাহরিয়ার কবির লাবিব (১৩) নামের এক স্কুলছাত্র নিহত হয়। সে পার্শ্ববর্তী গাড়াবাড়িয়া গ্রামের আহসানুল কবীরের ছেলে এবং ভি জে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিল। ২৪ ফেব্রুয়ারি জীবননগরের বাঁকা ব্রিক ফিল্ড এলাকায় ইটভাটার ট্রাক্টরের চাকায় পিষ্ট হয়ে একই গ্রামের আলমসাধুর চালক মো. আলিহিম হোসেন (৫৭) নিহত হন। ৫ মার্চ একই এলাকায় ভটভটির ধাক্কায় বিমা কর্মকর্তা মখলেছুর রহমান (৬০) এবং ৮ মার্চ দামুড়হুদার কলাবাড়ি গ্রামে বালুভর্তি ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে রজব আলী (৫৮) মারা যান।

ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের দুটি প্রতিবেদনেই ক্রমিক নম্বর ১-এ দেখানো হয়েছে, চুয়াডাঙ্গা শহরের বাগানপাড়ার বাসিন্দা গোল মোহাম্মদের মেয়ে রেখা খাতুন ও ক্রমিক নম্বর ২-এ দেখানো হয়েছে, দামুড়হুদার জাহাপুর গ্রামের নায়েব আলীর ছেলে শাহীনের নাম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ দুই দিনই তাঁরা শহরের পৌর কলেজ এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হন।

তথ্য যাচাইকালে দেখা গেছে, দামুড়হুদায় জাহাপুর নামে কোনো গ্রাম নেই। আবার রেখাকে গোল মোহাম্মদের মেয়ে দেখানোহলেও প্রকৃত অর্থে তিনি তাঁর স্ত্রী। রেখার নাতিতাছফিন আহমেদ জানান, ১ ফেব্রুয়ারি হাটতে বের হয়ে তাঁর নানি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। তবে ১ মার্চের দুর্ঘটনার তথ্যটি সঠিক নয়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফেব্রুয়ারি মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫ তারিখ সন্ধ্যা ছয়টায় জীবননগরের পেয়ারতলায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ওই গ্রামের আমিরুলের ছেলে কামরুল আহত হয়েছেন। এই কামরুলকে আমিরুল হোসেনের ছেলে কামাল দেখিয়ে ৫ মার্চ সন্ধ্যায় আরেকটি দুর্ঘটনায় আহত দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া ২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে জীবননগরের সন্তোষপুরে বাস ও আলমসাধু দুর্ঘটনায় রায়পুরের মনিরুলের ছেলে সাইদকে আহত দেখানো হয়েছে। ঘটনাস্থল ঠিক রেখে ২৩ মার্চ সকাল ৭টা ৩৫ মিনিটে সাইদকে সাইদুর ও তাঁর বাবা মনিরুলকে মনির দেখিয়ে আরেকটা দুর্ঘটনার তথ্য যোগ করা হয়েছে। একইভাবে ২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল সাতটায় সেনেরহুদার আলী হোসেনের ছেলে সাদিক উথলীতে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন বলে ওই মাসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হলেও মার্চ মাসের প্রতিবেদনে সাদিককে সাদিকুল এবং বাবার নাম হোসেন আলী দেখানো হয়েছে।

জেলার সিভিল সার্জন খায়রুল আলম বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে তথ্য সমন্বয়ের দায়িত্ব সদর হাসপাতালের অফিস সহকারীর। তিনি কী কারণে ভুল করলেন, বুঝতে পারছি না।’

সদর হাসপাতালের অফিস সহকারী প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সেটি যাচাই–বাছাই শেষে স্বাক্ষর করে জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠিয়ে দেন সিভিল সার্জন। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের প্রতিবেদনের ভুলগুলো তাঁর নজরে এসেছিল কি না, প্রশ্নে সিভিল সার্জন বলেন, ‘সব জিনিস তো আমাদের পক্ষে যাচাই–বাছাই করা সম্ভব নয়। অনেক কাজ করতে হয় আমাদের।’