অবসরের পরও সরকারি টাকায় বিদেশ সফর

>

• অবসরে যাওয়ার পরেও দুবারে তিনটি দেশ ভ্রমণ
• কখনো পদ্মা সেতু প্রকল্পের দামি গাড়ি ব্যবহার করেছেন
• সরকারি অর্থে বিদেশ ভ্রমণ ও গাড়ি-অফিস ব্যবহার করেছেন

সেতু বিভাগের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী কবির আহমেদ গত ডিসেম্বরে অবসরে গেছেন। কিন্তু এরপরও তিনি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুবারে তিনটি দেশ ভ্রমণ করেছেন। সেতু ভবনের ষষ্ঠ তলার একটি কক্ষে নিয়মিত অফিস করেছেন। কখনো কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের, কখনো পদ্মা সেতু প্রকল্পের দামি গাড়ি ব্যবহার করেছেন।

কোন আইনে কবির আহমেদ সরকারি অর্থে বিদেশ ভ্রমণ ও গাড়ি-অফিস ব্যবহার করেছেন, তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তিনি। জবাব দেয়নি সেতু বিভাগ কর্তৃপক্ষও।

সেতু বিভাগের সূত্রগুলো বলছে, এই অবিশ্বাস্য অনিয়ম সম্ভব হয়েছে কারণ, কবির আহমেদ সেতু বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের ঘনিষ্ঠজন। অবসরের পর তাঁকে চুক্তিতে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে রেখে দেওয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে সন্দেহের কারণে সরকারের উচ্চপর্যায় সাড়া দেয়নি। সেতু বিভাগের অধীনে ঢাকায় পাতালরেল নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। কবির আহমেদকে এই প্রকল্পের পরিচালক করার চেষ্টাও করা হয়।

শেষ পর্যন্ত কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক স্মেক ও যুক্তরাজ্যের কাউই (যৌথ) ২৩ এপ্রিল কবির আহমেদকে তিন বছরের জন্য তাদের পরামর্শক নিয়োগ করে। কবির মূলত সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন। তাঁকে প্রেষণে সেতু বিভাগে পাঠানো হয় ২০১২ সালে। গত ৩১ ডিসেম্বর তিনি অবসরে যান। কিন্তু কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পে নিয়োগের আগ পর্যন্ত তিনি সব সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন।

কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী। জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশের বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন সময় কাজে লাগানো হয়। এরই অংশ হিসেবে কবির আহমেদকে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অবসরের পরও কবির আহমেদের এই প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে হারুনুর রশিদ বলেন, প্রধান প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় কবির আহমেদ এই সুবিধা পেয়েছেন। পরে হয়তো কিছুদিন ব্যবহার করে থাকতে পারেন।

অবসরের পরও বিদেশ সফর, গাড়ি ও অফিস ব্যবহার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কবির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ইচ্ছায় নয়, সবকিছু সেতু বিভাগের ইচ্ছায় হয়েছে।

অবসরে যাওয়ার পর কবির আহমেদ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সরকারি খরচে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন। ওই সফরে ছয় সদস্যের সরকারি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। সফরের জন্য যে সরকারি আদেশ (জিও) জারি করা হয়েছে, তাতে সফরের ব্যয় পাতালরেলের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প থেকে বহন করার কথা বলা হয়েছে।

সর্বশেষ গত ৬ এপ্রিল গণখাতে ক্রয়সংক্রান্ত এক ডিপ্লোমা কোর্সে অংশ নিতে সেতু বিভাগের দুজন কর্মকর্তা এবং কবির আহমেদ কেনিয়া সফর করেন। তিনজনের সরকারি আদেশ (জিও) একসঙ্গে হয়। তবে এই সফরে কবির আহমেদের খরচ তিনি নিজে বহন করবেন বলে উল্লেখ রয়েছে।

কবির আহমেদ প্রধান প্রকৌশলীর পদে থাকা অবস্থায় ২০১৭ ও ২০১৮—এই দুই বছরে সাতবার বিদেশ সফর করেন। এর মধ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরে দুই দফায় গণখাতে ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়ে কোর্স সম্পন্ন করতে ইতালি যান।

সেতু বিভাগের তথ্য অনুসারে, গত বছরের জুলাই মাসে সাত সদস্যের একটি দল নিয়ে ১০ দিন তুরস্ক ও চীনে অবস্থান করেন কবির আহমেদ। দেশের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে চারটি সেতু নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প থেকে এই ভ্রমণের খরচ বহন করা হয়। এর আগে মার্চ-এপ্রিল মাসে তিনি চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতে ১০ দিন সফর করেন। এই সফরে তাঁর সঙ্গে সেতু বিভাগের আরও ৮ জন কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁদের সফরের খরচ বহন করে সেতু বিভাগ। মার্চের শুরুতে তিনি ৫ সদস্যের প্রতিনিধিদল নিয়ে চীন ভ্রমণ করেন।

২০১৭ সালের জুনে ছয় দিনের সফরে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে যুক্তরাজ্য সফর করেন কবির আহমেদ। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সমীক্ষার জন্য যে নৌকা কেনা হবে, তা দেখতে এই সফর করা হয়। কিন্তু কবির আহমেদ ওই প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না।

বর্তমানে কবির আহমেদ ঢাকা মেট্রো ঘ ১৩-৮৪৩৬ নম্বরের একটি প্রাডো গাড়ি ব্যবহার করেন। সেতু বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত ২৪ এপ্রিল এই গাড়িতে করে সেতু ভবনে আসেন তিনি। বিআরটিএতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই গাড়ি পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য কেনা হয়েছে। এই মডেলের আরও কিছু গাড়ি সেতু বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ও পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালকসহ কয়েকজন ব্যবহার করে থাকেন। ঢাকা মেট্রো ঘ-১৭-২৪৫০ গাড়িটিতেও তাঁকে চলতে দেখা যায়। এই গাড়ি কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের জন্য কেনা।

প্রকল্পের গাড়ি ও সরকারি অফিস ব্যবহার প্রসঙ্গে কবির আহমেদ বলেন, তাঁকে দিয়ে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের কিছু কাজ করানো হচ্ছে। এ জন্যই তিনি এগুলো ব্যবহার করছেন।

এর আগে গত ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাওয়ার পর ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮-০৯৬৪ নম্বরের একটি প্রাডো গাড়ি প্রায় তিন মাস ব্যবহার করেন কবির আহমেদ। বিআরটিএ সূত্র বলছে, এই গাড়ি কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের পরিচালকের নামে নিবন্ধন করা। ৪ এপ্রিলের পর গাড়িটি তিনি আর ব্যবহার করছেন না।

সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, প্রধান প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় তাঁর জন্য বরাদ্দ করা পাজেরো স্পোর্টসের বাইরেও আরও দুটি গাড়ি তাঁর পরিবারের সদস্য এবং তিনি নিজে ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রো ঘ ১৩-৮২১৯ পাজেরো স্পোর্টস গাড়িটি ঢাকা উড়ালসড়ক প্রকল্পের জন্য কেনা। ঢাকা মেট্রো ঘ ১৫-৬৬১৯ নম্বরের পাজেরো স্পোর্টস গাড়িটি সেতু কর্তৃপক্ষের।