মা ও দুই সন্তান হত্যাকাণ্ডের শিকার বলে ধারণা

স্বামী–স্ত্রী ও দুই সন্তান।  ফাইল ছবি
স্বামী–স্ত্রী ও দুই সন্তান। ফাইল ছবি
>

উত্তরখানে নতুন বাড়ি নির্মাণ করতে ঢাকায় আসে পরিবারটি। চিরকুটে লেখা আত্মহত্যা। পুলিশের সন্দেহ, অন্য কারণ থাকতে পারে।

রাজধানীর উত্তরখানের মৈনারটেকে একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছেলের গলা কেটে ও মা-মেয়ের শ্বাসরোধে মৃত্যু হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। গতকাল সোমবার দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকেরা এ তথ্য জানিয়েছেন। রোববার রাতে একটি ভাড়া বাসা থেকে পুলিশ তাঁদের লাশ উদ্ধার করে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাতে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে মা-মেয়ে আগে মারা গেছেন। এরপর ছেলের মৃত্যু হয়েছে।’ সুরতহাল প্রতিবেদনে ছেলেটির মুখ থেঁতলে দেওয়ার আলামত পাওয়া গেছে।

 নিহত ব্যক্তিরা হলেন মা জাহানারা বেগম (৪৫), ছেলে মুহিব হাসান (২৮) ও মেয়ে তাসপিয়া সুলতানা (২০)। উত্তরখানের ফকিরেরটেকে জাহানারা বেগমের বাবার কেনা জায়গায় বাসা তৈরির কাজের জন্য ভৈরবের জগন্নাথপুর থেকে এসেছিল ওই পরিবারটি। তারা প্রথম রমজান থেকে থাকতে শুরু করে।

চার ইউনিটের একতলা বাসায় ওই পরিবার ছাড়াও দুটি পরিবার ও চার ব্যক্তি ভাড়া থাকেন। বাসার তত্ত্বাবধায়ক মাহবুব আলাম জানান, চার ব্যক্তি একটি খাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। বাকি দুই পরিবারের একটির সদস্যরা মাসখানেক আগে থেকে উত্তরখানের উজানপুরে থাকছেন। অন্য পরিবারের শুধু তন্ময় বকশি নামের একজন থাকেন। এ ঘটনার ব্যাপারে তাঁরা কেউ কিছু বলতে পারেননি।

নিহত জাহানারার বড় বোনের স্বামী শিহাবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাসপিয়ার মানসিক ভারসাম্যহীনতা ও মুহিব চাকরির চেষ্টা করেও না পাওয়া ছাড়া তাঁদের আর কোনো সমস্যা ছিল না। কারও সঙ্গে তাঁদের কোনো বিবাদও ছিল না।’

রোববার রাতে ওই বাসা থেকে লাশ উদ্ধারের সময় পুলিশ একই কক্ষে মা-মেয়েকে খাটে ও ছেলেকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে। এ সময় মুহিবের পাশ থেকে একটি রক্তাক্ত বঁটি এবং মা-মেয়ের পাশ থেকে ট্যাবলেট, ওষুধের সিসি উদ্ধার করা হয়। কক্ষ থেকে দুটি চিরকুট পাওয়া যায়। যার একটিতে জাহানারার নাম উল্লেখ করে লেখা ছিল, ‘আমাদের ভাগ্য ও আত্মীয়স্বজনের অবহেলার কারণে আত্মহত্যা করলাম’ আর অন্যটিতে একই কথার পাশাপাশি লেখা ছিল, ‘সম্পদ যেন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করে দেওয়া হয়।’

পুলিশের ধারণা, দু-তিন দিন আগেই তাঁদের মৃত্যু হয়। গত ৪০তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন মুহিব। তাসপিয়া শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। উত্তরখান থানার পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) খন্দকার নাসির উদ্দিন জানান, গন্ধ পেয়ে স্থানীয় লোকজন পুলিশে খবর দিলে রাত সাড়ে নয়টার দিকে তাঁদের উদ্ধার করা হয়। বাসাটির ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগানো ছিল।

বাসার তত্ত্বাবধায়ক মাহবুব আলম বলেন, প্রথম রমজানের আগের রাতে বাসায় ওঠার সময় দুটি ট্রাকে করে মালামাল নিয়ে আসে ওই পরিবার। এর মধ্যে ছিল দুটি ফ্রিজ, তিনটি খাট, ড্রেসিং টেবিল। মালামাল নামানোর জন্য ভৈরব থেকেই শ্রমিক নিয়ে আসা হয়েছিল।

এদিকে গতকাল ভৈরবে পরিবারটির স্বজনেরা প্রথম আলোকে বলেছেন, জাহানারার স্বামী ইকবাল হোসেন একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক ছিলেন। ২০১৬ সালে মৌলভীবাজারের বড়লেখায় কর্মরত অবস্থায় হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। এরপর ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি বাসায় ভাড়া থাকার পর পরিবারটি দুই মাস আগে ভৈরবে চলে যায়। সেখানে নিজস্ব ঘর না থাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করে। সেখান থেকে ৫ মে উত্তরখানে চলে আসে।

ভৈরবে ভাড়া বাসার মালিক সারোয়ার মাহমুদ জানিয়েছেন, মুহিব বাবার বাড়িতে ঘর নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জায়গা বণ্টন না হওয়ায় সেটি করতে পারেননি।

মুহিবের মা জাহানারাকে ওই বাসা ভাড়া নিতে সহযোগিতা করেছিলেন দূরসম্পর্কের আত্মীয় ও ফকিরেরটেকের বাসিন্দা নসরুল আলম। তিনি বলেন, রোববার ইফতারের পর ওই বাসায় গিয়ে কারও কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কেয়ারটেকারকে ফোন দেন। তিনি এলে বাসার পেছনের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখেন, খাটের ওপর মা-মেয়ে আর মেঝেতে ছেলের লাশ পড়ে আছে। এরপর পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।

উত্তরা বিভাগের এডিসি হাফিজুর রহমান বলেন, চিরকুটে আত্মহত্যা লেখা থাকলেও এটি আত্মহত্যা কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।