২০০ বছর আগে লিচুর আবাদ শুরু মঙ্গলবাড়িয়ায়

মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের লিচুগাছে ঝুলছে গোলাপি রঙের লিচু। ছবি: তাফসিলুল আজিজ
মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের লিচুগাছে ঝুলছে গোলাপি রঙের লিচু। ছবি: তাফসিলুল আজিজ

বরকতুল্লাহ নামের এক ব্যক্তি চীনে গিয়েছিলেন পড়তে। আসার সময় সঙ্গে নিয়ে এলেন লিচুর দুটি চারা। সে অনেক আগের কথা, ১৮০২ সাল। চারাগুলো রোপণ করলেন তাঁর গ্রাম কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার মঙ্গলবাড়িয়া মাদ্রাসায়। লিচু চাষের শুরু নিয়ে এ তল্লাটে এমন জনশ্রুতি আছে। স্থানীয় বয়স্করাও এর পক্ষে কথা বলেন। তাঁদের দাবি, পাকুন্দিয়ার মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের লিচুর ২১৭ বছরের ঐতিহ্য রয়েছে। আর কালক্রমে গ্রামটি লিচু-গ্রাম নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

এ মৌসুমে লিচুর বাম্পার ফলন পেয়েছেন মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের লিচুচাষিরা। চাষিরা জানান, আবহাওয়া ভালো থাকায় এবার লিচুর ফলন ভালো হয়েছে। শুধু মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের পাঁচ হাজার লিচুগাছ থেকে অন্তত ১০ কোটি টাকা আয়ের আশা করছেন চাষিরা।

এখন প্রায় এক বর্গকিলোমিটারের এই মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের প্রতিটা বাড়ির উঠান, বাড়ির সামনের অংশ, পুকুরপাড়, খেতের আইলসহ সব জায়গায় লিচুগাছ।

গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে, গাছে গোলাপি রঙের মনকাড়া লিচু ঝুলে আছে। প্রতিটি বাড়িতেই স্বজনদের আনাগোনা। বাড়ির সামনে পেতে রাখা হয়েছে চেয়ার। সেখানে বসে গল্প করছেন লিচুগাছের মালিকসহ দূরদূরান্ত থেকে লিচু কিনতে আসা ব্যক্তিরা। অনেকেই গাছ থেকে লিচু পাড়ছেন। কেউ কেউ আবার পাটি বিছিয়ে বসে লিচু থেকে পাতা সরিয়ে গুনে গুনে ৫০টি–১০০টি করে আঁটি বাঁধছেন।

মো. নাজমুল ইসলাম মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে এসেছেন লিচু কিনতে। তিনি বলেন, এই সময়টার জন্য প্রতিবছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। সারা বছর এ লিচুর স্বাদ যেন মুখে লেগেই থাকে। সে জন্য প্রতিবছর এখান থেকে টাটকা লিচু কিনে নিয়ে স্বজনদের বাড়িতেও পাঠান।

মো. জাকির হোসেন বলেন, তিনি ৪০০ টাকা দিয়ে ১০০ লিচু কিনেছেন। দাম কিছুটা বেশি হলেও অন্য এলাকার লিচুর চেয়ে এই এলাকার লিচুর গুণগত মান ভালো। এ লিচুর একধরনের সুঘ্রাণ রয়েছে। বিচি ছোট হওয়ায় শাঁসের পরিমাণ বেশি থাকে। লিচু আকারেও বড়। তা ছাড়া এর রয়েছে নজরকাড়া রং। দেখলেই খেতে ইচ্ছে হয়।

লিচু থেকে পাতা সরিয়ে গুনে গুনে আঁটি বাঁধছেন মঙ্গলবাড়িয়ার কয়েকজন। ছবি: তাফসিলুল আজিজ
লিচু থেকে পাতা সরিয়ে গুনে গুনে আঁটি বাঁধছেন মঙ্গলবাড়িয়ার কয়েকজন। ছবি: তাফসিলুল আজিজ

মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের লিচুচাষি মো. তৌহিদ মিয়া জানান, এবার তাঁর নিজের কয়েকটি গাছ ছাড়াও আরও ১৫০টি লিচুগাছ কিনেছেন। এ গাছগুলো তিনি গত বছর লিচু শেষ হওয়ার পরেই অনেক কম টাকায় কিনেছেন। তারপর সন্তানের মতো এগুলোকে যত্ন করে সময়মতো কীটনাশক ও পানি ব্যবহার করেছেন। সে জন্য এবারও বাম্পার ফলন পেয়েছেন। লিচু অল্পস্বল্প বিক্রি শুরু করেছেন।

তৌহিদ মিয়া বললেন, আরও ২০ দিনের মতো বিক্রি করতে পারবেন। এবার ভালো লাভ পাবেন বলে তিনি আশা করছেন। তিনি জানান, এ এলাকার বেশির ভাগ মানুষ স্বজনদের উপহার হিসেবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় লিচু পাঠান। দেশের সীমান্ত পেরিয়ে দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও লন্ডনপ্রবাসীদের কাছেও পৌঁছায় এ গ্রামের লিচু। লিচুর জন্য আগেভাগেই অনেকেই অর্ডার দিয়ে রাখেন। কেউ আবার পছন্দমতো লিচুভর্তি গাছ ও ডাল কিনে রাখেন। লিচু পুরোদমে পাকলে তাঁদের নিজেদের কেনা গাছ ও ডাল থেকে লিচু তুলে নিয়ে যান।

পাকুন্দিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল হাসান বলেন, মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের বেলে ও দোআঁশ মাটি লিচু চাষের জন্য উপযোগী। তা ছাড়া কৃষি বিভাগের পরামর্শে এবার লিচুচাষিরা সময়মতো ওষুধ ব্যবহারসহ গাছ পরিচর্যা করায় তাঁরা বাম্পার ফলন পেয়েছেন। সঠিক দাম ও বেশি লাভ পাওয়ায় এলাকার চাষিরাও লিচু চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। সে জন্য এলাকায় দিন দিন লিচুগাছের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।