লিবিয়া থেকে ইতালি তিন ধাপে

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

১৯ বছর আগে দেশ ছেড়েছিলেন ফেনীর হারুন উর রশীদ। প্রথমে যান লিবিয়ায়। সেখানে পানির লাইন নির্মাণকারী একটি কোরীয় কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। এরপর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছান ইতালি। বর্তমানে সেখানে মাসিক ১ হাজার ৬০০ ইউরোর বিনিময়ে কাজ করছেন একটি মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানে।

ছুটি কাটাতে সম্প্রতি দেশে এসেছেন হারুন। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বসে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে জানান, নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে লিবিয়া থেকে কীভাবে ইতালি গেলেন।

৯ ও ১০ মে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে একটি নৌকাডুবিতে নিখোঁজ হন ৩৯ বাংলাদেশি। তিউনিসিয়া উপকূলে আরেকটি নৌকাডুবিতে উদ্ধার হওয়া ১৫ জন বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত আনা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুজন ও হারুনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশি টাকা উপার্জনের আশায়ই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার মতো ঝুঁকি নেন অনেক বাংলাদেশি।

হারুনের ভাষ্য, লিবিয়া থেকে ইতালি পৌঁছাতে তিনটি ধাপ পার হতে হয় অভিবাসীদের। এর মাঝে প্রাণ হারান অনেকে। আবার ছোট নৌকায় ভাসতে ভাসতে অনেকে পৌঁছান ইতালিতে।

নিজের ইতালি যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে হারুন বলেন, ‘২০০০ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় যাই। সেখানে কয়েক বছর একটি কোরীয় কোম্পানিতে কাজ শুরু করি। বেতন ছিল কম। লিবিয়ায় আসার সময় যে টাকা ধার করেছিলাম, বেতনের টাকা দিয়ে সেটা পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ২০০৭ সালে ইতালি যাওয়ার চিন্তা মাথায় আসে। শুরু হয় ইতালি যাওয়ার প্রথম ধাপ।’

হারুন বলেন, প্রথম ধাপে দালাল ধরি। কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে দালালের সঙ্গে চুক্তি হয়—জাহাজে করে ইতালি পৌঁছে দেবে। ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি দল হওয়ার পর তাঁদের মধ্যে থেকেই কয়েকজনকে বাছাই করে সাগরে কম্পাস (দিক নির্ণয়ের যন্ত্র) ধরে পথ চেনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ইতালির উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয় লিবিয়ার জোয়ারা ও তাজোরা উপকূল থেকে। যাত্রা শুরুর পর প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরাই নৌকা চালাতে শুরু করেন। দালালেরা সঙ্গে থাকেন না। নৌকা ছাড়ার পর কারও দায়িত্বও নেন না তাঁরা। যাত্রা শুরুর পর গন্তব্য নির্ধারণ করা হয় ইতালির সিসিলি দ্বীপে। কিন্তু কয়েক দিনের প্রশিক্ষণে সাগরে সঠিকভাবে দিক নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে, অনেক সময় ভুল করে নৌকা পৌঁছায় ভূমধ্যসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র মাল্টায়। সেখানে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে আবার লিবিয়ায় ফেরত পাঠানো হয়। অনেক সময় কোনো দিকই নির্ণয় করতে না পারায় নৌকা ভাসতে ভাসতে সাগরেই হারিয়ে যায়।

নৌকা সিসিলিতে পৌঁছালে শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপের কাজ। এটি হলো ইতালির নৌবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করা। এরপর অভিবাসীদের নেওয়া হয় কারাগারে। সেখানে শুরু হয় তৃতীয় ধাপের কাজ।

হারুন বলেন, তৃতীয় ধাপ হলো রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া। ইতালির পুলিশ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন সাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার সুযোগ করে দেয়। সেটি অনুমোদন পেলে অভিবাসীরা ইতালিতে বসবাস করতে শুরু করেন। আর অনুমোদন না পেলে ব্যক্তিকে ইতালি ছেড়ে নিজের দেশের যাওয়ার জন্য ছয় দিনের সময় দেয় পুলিশ।

তিউনিসিয়া থেকে দেশে ফেরত আসা ১৫ জনের মধ্যে সোহেল রানা ও আমির হোসেন নামের দুজন ব্যক্তিও মুঠোফোনে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে এই তিনটি ধাপের কথা বলেছেন। তবে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে যাওয়ায় ফেরত আসতে হয়েছে তাঁদের। আমির হোসেন বলেন, ‘নৌকাডুবির ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কিন্তু তারপরও বেশি টাকা আয়ের লোভে ঝুঁকির পথে পা বাড়িয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে টাকার চেয়ে জীবনটাই বড়।’