সিলেটে রিকশাভাড়ার তালিকা আছে, মানে না কেউ
সিলেট নগরে দূরত্ব অনুযায়ী রিকশাভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল সাড়ে তিন বছর আগে। সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ তখন ভাড়ার তালিকা সাঁটিয়ে দেয় নগরের গুরুত্বপূর্ণ ৫১টি মোড়ে। তবে রিকশাচালকেরা শুরু থেকেই ওই তালিকা মানছেন না। অতিরিক্ত ভাড়া দিতে রাজি না হলে তাঁরা যাত্রী পরিবহনে অপারগতা জানাচ্ছেন। এ অবস্থায় অনেকটা বাধ্য হয়েই যাত্রীরা চালকের দাবিকৃত ভাড়ায় চলাচল করছেন।
জানতে চাইলে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাগরিকদের সুবিধা নিশ্চিত করতেই সিটি কর্তৃপক্ষ সব মহলের মতামতের ভিত্তিতে একটি যুক্তিসংগত রিকশাভাড়ার তালিকা নির্ধারণ করেছে। তালিকার বাইরে চালকেরা টাকা চাইলেই কেন দিতে হবে? এটা ব্যক্তির সচেতনতার বিষয়।’ চালকেরা যেকোনো কারণ দেখিয়ে অন্যায্য দাবি করলেও যেন কেউ বেশি টাকা না দেন, নগরবাসীর প্রতি সেই অনুরোধ রেখেছেন মেয়র।
সিটি করপোরেশনের লাইসেন্স শাখা সূত্রে জানা গেছে, নগরে রিকশা ভাড়া নিয়ে প্রায়ই যাত্রী ও চালকদের মধ্যে বচসা হয়। এ অবস্থায় নগরবাসী দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। পরে এ বিষয়ে নগরের ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মতামত নেওয়া হয়। তার ভিত্তিতে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রিকশাভাড়া নির্ধারণের জন্য সিটি কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির মতামত নিয়ে রিকশাভাড়ার একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়। সেটি ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসের ১৫ তারিখ থেকে কার্যকর হয়।
তালিকায় প্রতি কিলোমিটার ১০ টাকা এবং ঘণ্টাপ্রতি ৫০ টাকা হারে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল সোমবার নগরের বিভিন্ন এলাকার ১৯ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলছেন, ভাড়া নির্ধারিত হলেও সেটি কখনোই অনুসরণ করেন না রিকশাচালকেরা। তাই ভাড়ার ওই তালিকা শুরু থেকেই অকার্যকর। নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ-তিন গুণ দাবি করে আসছেন চালকেরা। প্রতি কিলোমিটারে ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত দাবি করে বসেন তাঁরা। বাড়তি টাকা না দিতে না চাইলে চালকেরা যাবেন না বলে জানিয়ে দেন। তখন বাধ্য হয়ে বাড়তি টাকায় যান যাত্রীরা, না হয় রিকশা না পেয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েন।
নাগরিক জোট সিলেটের সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল কাইয়ূম বলেন, ‘রিকশাভাড়ার তালিকা প্রকাশের সময় সিটি কর্তৃপক্ষ বলেছিল এটি চালক, মালিক ও যাত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার মতামতের ভিত্তিতেই প্রস্তুত করা হয়েছে। সেটি যদি হয়ই, তবে কেন রিকশাচালকেরা এ তালিকা মানতে চাইছেন না? নগরবাসীর দুর্ভোগ লাঘবে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে এ নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।’
সিটি করপোরেশন যে রিকশা ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেটা অনেক চালকই জানেন না। গতকাল বিকেলে এমন পাঁচজন রিকশা চালকের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। অন্যরা স্বীকার করেন, তাঁরা নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি টাকা নেন। এর পেছনে নানা যুক্তি তাঁদের। যেমন, বিভিন্ন উৎসবের সময় বেশি ভাড়া নেওয়াটা একটা প্রথায় পরিণত হয়েছে। আবার রাতে বা প্রতিকূল আবহাওয়ার সময় বেশি ভাড়া চান রিকশাচালকেরা।
রহিমুদ্দিন নামের নগরের বালুচর এলাকার এক রিকশাচালক বলেন, ‘রাইত বেশি হইলে, বৃষ্টিবাদলা থাকলে, রইদ থাকলে আমরা ভাড়া একটু বেশি চাই। ঈদের সময়ও ভাড়া বলন (বেশি) চাই। তবে জোরাজুরি করি না। যাত্রীরা খুশি হইয়াই টেকা বেশি দেয়।’
তবে ভাড়া নিয়ে অনেক সময় যাত্রীদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক বেঁধে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন কয়েকজন রিকশাচালক। নগরের বারুতখানা এলাকার চল্লিশোর্ধ্ব রিকশাচালক কবির মিয়া বলেন, প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় সিলেটে এমনিতেই রিকশা ভাড়া একটু বেশি। এ ছাড়া অতিরিক্ত রোদ কিংবা বৃষ্টির সময় স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি ভাড়া চান তাঁরা। দেশের সব জায়গাতেই এমন চল রয়েছে।
নগরের কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, দূরত্ব অনুযায়ী নির্ধারিত ভাড়া ঠিকই আছে। তবে সিলেট শহরের অধিকাংশ রিকশাচালকই সিলেটের বাইরের। তাঁরা জানেন, এই শহরে অসংখ্য প্রবাসীর স্বজনেরা থাকেন। অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এ শহর তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল। এসব বিষয় মাথায় রেখেই চালকেরা রিকশা ভাড়া মাত্রাতিরিক্ত দাবি করে থাকেন। সচ্ছল যাত্রীরা চালকদের সঙ্গে এ নিয়ে বচসা না করে দাবিকৃত টাকা দিয়ে দেন। আসল ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষজন। কারণ, মাত্রাতিরিক্ত রিকশাভাড়া দিতে গিয়ে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
নগরের রায়নগর এলাকার বাসিন্দা মোছাব্বির হোসেনের সঙ্গে গতকাল বেলা দেড়টার দিকে জিন্দাবাজার এলাকায় কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি মীরাবাজার এলাকা থেকে জিন্দাবাজার এসেছি। এই দূরত্বের ভাড়া ১৫ টাকা। অথচ আমাকে ৩০ টাকা দিয়ে আসতে হয়েছে। চালক বলছেন, ঈদের মৌসুম। তাই বেশি ভাড়া না দিলে তিনি আসবেন না। এভাবে নানা অজুহাতে যাত্রীদের রীতিমতো জিম্মি করে বাড়তি ভাড়া আদায় করেন রিকশাচালকেরা। এই পরিস্থিতির অবসান হওয়া উচিত।’