'সময় এখন কালোটাকার মালিকদের'

সময় এখন কালোটাকার মালিকদের, সময় এখন লুটেরাদের ও অর্থ পাচারকারীদের। প্রস্তাবিত বাজেট মূলত ব্যবসায়ীবান্ধব। এতে ধনীদের আরও ধনী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

গতকাল রোববার জাতীয় সংসদে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দলের সাংসদেরা এসব কথা বলেছেন। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিকেলে অধিবেশন শুরু হয়। পরে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়াও অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। সম্পূরক বাজেটের ওপর আওয়ামী লীগের পাঁচজন, জাতীয় পার্টির চারজন, বিএনপির তিনজন ও গণফোরামের একজন সাংসদ বক্তব্য দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন।

সরকারি দলের মন্ত্রী ও সাংসদেরা প্রস্তাবিত বাজেটকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেন। প্রায় একই সুরে কথা বলেন জাতীয় পার্টির কয়েকজন সাংসদও। তবে সংসদ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বিএনপির সংরক্ষিত আসনের সাংসদ রুমিন ফারহানা বক্তব্য দেওয়ার সময়।

বিরোধী দলের বক্তব্যে কালোটাকা, খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচার, গত সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা, দুর্নীতি, বাজেট বাস্তবায়নের দুর্বলতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক প্রসঙ্গ উঠে আসে। সরকারি দলের মন্ত্রী ও সাংসদেরা কিছু কিছু বিষয়ের জবাবও দেন।

অধিবেশনের শুরুর দিকে সরকারি দলের মতিয়া চৌধুরী সুন্দর একটি নির্বাচন উপহার দেওয়ায় নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সাবেক একজন সচিব বাজেটকে যে সংখ্যাতত্ত্বের দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন, তার সমালোচনা করেন মতিয়া চৌধুরী।

গণফোরামের সাংসদ মোকাব্বির খান বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটকে অর্থমন্ত্রী নাম দিয়েছেন ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ, সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’। বাস্তবে সময় এখন কালোটাকার মালিকদের, সময় এখন লুটেরাদের এবং অর্থ পাচারকারীদের।

স্মার্ট বাজেটের সমালোচনা করে মোকাব্বির খান আরও বলেন, আসলেই এটা স্মার্ট বাজেট। এই বাজেটেই ধনীদের আরও ধনী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। জাতির জনকের কন্যা নিশ্চয়ই জানেন, ২২ পরিবার আজ হাজার পরিবারে পরিণত হয়েছে।

জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম বলেন, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না। অথচ এই ফাঁকে ১৬ হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেল। ঋণখেলাপিদের অবলোপন করারও সুযোগ দেওয়া হয়। মানুষ পকেটের টাকা এনে ব্যাংকে রাখেন। অথচ ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি। দেড় লাখ কোটি টাকা ঋণখেলাপিদের কাছে গেলে ব্যাংক খাতের সমস্যা তো হবেই। সুদের হার কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনেক সুবিধা নিলেও তাঁরা আর সুদের হার কমাননি।

ফখরুল ইমাম বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট ব্যবসায়ীবান্ধব। অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা, যিনি আবার একজন সাংসদ—সবাই ব্যবসায়ী। বাজেটে ভ্যাটের বিষয়টি এখনো ঠিক হলো না। ভ্যাট কি শিল্পের ওপর না পণ্যের ওপর? প্রশ্ন তাঁর।

জাতীয় পার্টির আরেক সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, সম্পূরক বাজেট পাস হয়ে যাওয়ার পরই মন্ত্রীরা রাজা হয়ে যান। এরপর তাঁদের কাছে সাংসদদের আর মূল্যায়ন থাকে না।

বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ওয়াশিং মেশিন বলে অভিহিত করেন।

বিএনপির রুমিন ফারহানা সাংসদদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা কেউ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হননি। সংবিধানের ৬৫(২) ধারায় বলা আছে, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে হবে। আল্লাহকে হাজির–নাজির জেনে বলুন, এখানে যাঁরা আছেন, তাঁরা কয়জন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন! নিজেদের বিবেককে প্রশ্ন করুন।’ তাঁর এ বক্তব্যের সময় সরকারদলীয় ও জাতীয় পার্টির সাংসদেরা হইচই করেন।

রুমিন ফারহানা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক উল্লেখ করে বক্তব্য শুরু করলে সংসদে হইচই বেড়ে যায়। তখন রুমিনের উদ্দেশে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, ‘আপনাকে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করব, আপনি এমন কোনো কথা বলবেন না, যেটাতে অপর পক্ষ উত্তেজিত হবে এবং সংসদ পরিচালনায় ব্যত্যয় ঘটবে। আমি চাই সংসদটা প্রাণবন্ত হোক।’

রুমিন বলেন, ‘যখন আমরা সংসদে যোগ দিই, তখন আমাদের বলা হয়েছিল, আমরা আমাদের কথা বলতে পারব। কিন্তু আমার প্রথম দিনের বক্তব্য ছিল দুই মিনিট, আমি এক মিনিটও শান্তিতে কথা বলতে পারিনি। একই ঘটনা আজকেও ঘটছে। তাহলে আমরা কোন গণতন্ত্রের কথা বলি, কোন বাক্‌স্বাধীনতার কথা বলি, কোন সংসদের কথা বলি। এভাবে তো একটা সংসদ চলতে পারে না।’

রুমিন বলেন, ‘আমি আমার দলের কথা বলব, তারা তাদের দলের কথা বলবে। কিন্তু আমি উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সংসদ যদি এভাবে উত্তেজিত হয়ে যায়, ...।’ এ সময় স্পিকার রুমিনকে বাজেটের বাইরে কথা না বলার অনুরোধ জানান।

এ পর্যায়ে রুমিন ফারহানা বলেন, একটা সরকারের সক্ষমতা ক্রমেই বাড়ার কথা। কিন্তু এ সরকারের সক্ষমতা ধীরে ধীরে কমছে। ২০১০-১১ থেকে শুরু করে আজকে পর্যন্ত বাজেটের মাত্র ৭৬ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে পারি না। বাজেট বাস্তবায়নে ঘাটতি দেখতে পাই।

রুমিন ফারহানা বলেন, গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই) বলেছে, বাংলাদেশ থেকে সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এই টাকা দিয়েই বেগমপাড়া তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক লুট হয়, বিচার হয় না। ১৫ লাখ টন কয়লা নাই হয়ে যায়, বিচার হয় না।

বর্তমান সংসদ নির্বাচিত নয় দাবি করে রুমিন বলেন, ‘এরপরও আমরা সংসদে যোগ দিয়েছি। কারণ, আমাদের মিছিল করতে দেওয়া হয় না, জনসমাবেশ করতে দেওয়া হয় না। ভেবেছি, আমরা সংসদে একটা জায়গা পাব। যেখানে আমরা দেশের কথা, জনগণের কথা, আমাদের নেতা-কর্মীদের কথা বলতে পারব।’ দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা, মানবাধিকার পরিস্থিতিরও সমালোচনা করেন তিনি।

পরে স্পিকার বলেন, সম্পূরক বাজেটের বাইরে দেওয়া রুমিনের অসংসদীয় শব্দগুলো সংসদের কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়া হবে।

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ফখরুল ইমামের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ব্যবসায়ী হওয়া কি অপরাধ? বিশ্বের অনেক দেশের সংসদেই ব্যবসায়ী আছেন। সুতরাং ব্যবসায়ী শব্দ দিয়ে গালি দেওয়া ঠিক নয়।

বিএনপির হারুনুর রশীদ প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘আজকে সংসদ নেতা এখানে আছেন। অনেকে আমাদের বলেন, আপনারা সংসদকে অবৈধ বলেছেন কেন? আজকে স্পষ্টভাবে বলছি, আমরা ছয়জন সংসদে প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে এই সংসদ বৈধতা পাবে না।’

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ রুমিন ফারহানার কথার জবাব দেওয়া শুরু করলে স্পিকার বলেন, কথাগুলো যেহেতু এক্সপাঞ্চ করা হবে, এগুলো নিয়ে আর কথা বলার দরকার নেই। প্রতিমন্ত্রী তখন সরকারের উন্নয়ন পরিস্থিতি তুলে ধরেন।

বাজেট অধিবেশন আজ সোমবার বেলা তিনটা পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।