উত্তরাঞ্চলে শহরেও ঢুকেছে পানি, বাড়ছে মৃত্যু

>

গাইবান্ধায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জেলা শহরের পি কে বিশ্বাস সড়কে জেলা প্রশাসকের বাসভবনেও উঠেছে পানি। গতকাল বিকেলে।  ছবি: প্রথম আলো
গাইবান্ধায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জেলা শহরের পি কে বিশ্বাস সড়কে জেলা প্রশাসকের বাসভবনেও উঠেছে পানি। গতকাল বিকেলে। ছবি: প্রথম আলো

গাইবান্ধা শহরে পানি ঢুকেছে। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে জেলা প্রশাসকের বাসভবনের চত্বর। কুড়িগ্রামের রাজীবপুর শহরে উপজেলা পরিষদেও পানি উঠেছে।

পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টির কারণে গতকাল মঙ্গলবার উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর পানি কমলেও দুর্গত ব্যক্তিদের দুর্ভোগ কমেনি। নীলফামারীতে পানি এখনো বিপৎসীমা বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে। ঠাকুরগাঁওয়েও ঢুকেছে বন্যার পানি।

বন্যার পানিতে ডুবে কুড়িগ্রামে ১৩ জন মারা গেছেন। রাজীবপুর শহরে উপজেলা পরিষদ চত্বর, কার্যালয় ও বাজারে পানি উঠেছে। রৌমারী ও নাগেশ্বরীতে বাঁধ ভেঙে নতুন করে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গাইবান্ধা শহরে পানি ঢুকেছে। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে জেলা প্রশাসকের বাসভবনের চত্বর। লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলায় একটি সেতুর সংযোগ সড়ক ভেঙে গেছে।

কুড়িগ্রামে ডুবে ১৩ জনের মৃত্যু

কুড়িগ্রামের উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়নে গতকাল রুনা বেগম (২৮), রুপা মণি (৮), হাসিবুল ইসলাম (৭), সুমন (৮) ও রুকু মণি (৮) বন্যা দেখতে বেরিয়ে নৌকা ডুবে মারা গেছে। রুনা নতুন অনন্তপুর এলাকার রেজাউল ইসলামের স্ত্রী। রুপার বাবা মহসিন আলী। হাসিবুলের বাবা আয়নাল হক। নিখোঁজ সুমনের বাবা মনসুর আলী। রুকুর বাবা রাশেদ আলী। একই ইউনিয়নে বাড়ির পেছনে খেলতে গিয়ে মো. হাবিবুল্লাহ (৬) নামের এক শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। সে ব্যাপারীপাড়া গ্রামের মাহবুর রহমানের ছেলে। চিলমারী ইউনিয়নের গাছবাড়ী এলাকার মাইদুল ইসলামের দেড় বছরের মেয়ে মনি খাতুন খেলতে খেলতে পানিতে পড়ে মারা গেছে। অষ্টমীর চরের খর্দ্দ বাঁশপাতারী গ্রামের ফরিদুল ইসলামের ৯ মাসের ছেলে হাসানুল হক চৌকি থেকে পড়ে এবং চুনমুলপাড়ার বীথি আক্তার (১০) পানিতে ডুবে মারা গেছে। গত সোমবার নাগেশ্বরী উপজেলার কালীগঞ্জ ইউনিয়নের মাধাইখাল এলাকায় হেঁটে সড়ক পাড় হওয়ার সময় পানির স্রোতে ভেসে যান আক্তারুজ্জামান মামুন (৪০)। গতকাল তাঁর লাশ ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল উদ্ধার করেছে। রৌমারীর কর্ত্তিমারীতে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে পানিতে পড়ে সাইফুল ইসলাম (২৫) নামের একজন নিখোঁজ হয়েছেন। রৌমারী ফায়ার সার্ভিস তাঁকে খুঁজছে। ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের আটোয়াটারী গ্রামের লোকমান হোসেনের মেয়ে আলো খাতুন (৩) পানিতে ডুবে মারা গেছে।

এদিকে কুড়িগ্রামে ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানিবন্দী মানুষ খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও আশ্রয়ের সংকটে ভুগছেন। চরাঞ্চলে গোখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। বানভাসি লোকজন পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন।

গাইবান্ধা শহরেও ঢুকেছে পানি

গতকাল দুপুরে গাইবান্ধা শহরে পানি ঢুকেছে। শহরের পূর্বপাড়া, কুটিপাড়া, মুন্সিপাড়া, বানিয়ারজান, ডেভিট কোম্পানিপাড়া, নতুন বাজার, ব্রিজ রোড এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে শহরের সার্কুলার রোডে জেলা প্রশাসকের বাসভবন।

গত সোমবার সদর উপজেলার ফারাজিপাড়া ও গোদারহাট এলাকা দিয়ে পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গতকাল গাইবান্ধা-বালাসি সড়কের প্রায় দুই কিলোমিটার অংশ ডুবে গেছে। এ সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি।

ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক রোখসানা বেগম বলেন, বন্যাকবলিত চারটি উপজেলায় ৪০০ মেট্রিক টন চাল এবং দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বিতরণ শুরু হয়েছে। নতুন করে আরও ১ হাজার মেট্রিক টন চাল, ১০ লাখ টাকা এবং ৫ হাজার শুকনো খাবার প্যাকেট বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

নীলফামারীতে ১৪ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ

নীলফামারীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে গতকাল বেলা তিনটায় লালমনিরহাটের দোয়ানীতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা বরাবর প্রবাহিত হচ্ছিল। প্রবল বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে ডিমলা উপজেলার ১৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা ক্ষয়ক্ষতি দেখানো হয়েছে। তবে মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান বন্ধ নেই বলে জানিয়েছেন জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম।

লালমনিরহাটে সংযোগ সড়ক ভেঙেছে

লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার সরকারের হাট-ধবলগুড়ি সড়কের জোড়াপুল এলাকায় সেতুর সংযোগ সড়ক ভেঙে গেছে। এতে প্রায় ২০ হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে। গত রোববার রাতে ধরলার পানির চাপে সড়কটি ভেঙে যায়। এ জেলায় তিস্তার পানি কমতে শুরু করলেও বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। শুকনো খাবার ও গোখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।

খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের আবদুল মজিদ বলেন, ‘হামরা এলা রিলিফ চাই না। গরু-ছাগলের খাবার চাই।’

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত জেলা কর্মকর্তা মকবুল হোসেন বলেন, প্রায় আট হাজার গবাদিপশু বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুকনো খড়ের সংকটে ভুগছেন কৃষক। গতকাল সকালে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এ কে এম খালিদ মাহমুদ সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি ও মোকাবিলা বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন।

ঠাকুরগাঁওয়ে আবাদি জমি সয়লাব

অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পানিতে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জের টাঙ্গন, লাচ্ছি, চরণা, বাদলিয়া ও জলুই নদের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বিল-খাড়ি ও বোরো আবাদযোগ্য জমি পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। এ কারণে আমন ধানের চারা রোপণ করতে পারছেন না কৃষকেরা। বীজতলার চারার বয়স বেড়ে যাওয়ায় এবার আমন ধানের ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম গোলাম সারোয়ার বলেন, এবার এখানে বন্যা না হলেও নদীনালা, মাঠঘাট পানিতে ডুবে আছে। বয়স বেড়ে যাওয়া থেকে আমনের চারা বাঁচাতে চাষিদের প্রতি কৃষি বিভাগের পরামর্শ হলো—বীজতলা থেকে বীজ তুলে ‘দোগুছি’ করে রাখতে হবে।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট, পাটগ্রাম ও পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও]