জীবন কেড়ে নেওয়া শ্রম

লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বুড়িমারী ইউনিয়নের আবদুস সালাম পাথর ভাঙার কাজ করতেন। দুই বছর কাজ করার পর প্রথমে কাশি এবং পরে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। রংপুর মেডিকেলে তাঁর রোগ ধরা পড়ছিল না। এরপর যান জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। সেখানে তাঁর সিলিকোসিস রোগ ধরা পড়ে। তাঁর জীবন এখন দুঃসহ যন্ত্রণার। 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, যেসব শ্রমিক পাথর কাটা, ভাঙা ও গুঁড়া করার কাজ করেন, তাঁরা সিলিকোসিসে আক্রান্ত হন। কোয়ার্টজ, গ্রানাইট, চুনাপাথরসহ বিভিন্ন পাথরে থাকা স্বচ্ছ সিলিকা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে যেসব শ্রমিকের ফুসফুসে ঢুকে এই রোগ হয়।

আবদুস সালাম বলেন, ২০০৮-০৯ সাল পর্যন্ত তিনি এলাকার একটি পাথর ভাঙার কারখানায় কাজ করেছেন। সেখানে কাজ করার সময় সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্টসহ তাঁর নানা স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে ২০১০ সালে ঢাকার জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর এখন বাড়িতে আছেন। চিকিৎসার পেছনে প্রতিদিন তাঁর ৪৮০ টাকা খরচ হয়। তিনি এখন ভারী কাজ করতে পারেন না। শরীর ক্রমে শুকিয়ে যাচ্ছে।

সিলিকোসিসে মারা যাওয়া উপজেলার উফারমারা গ্রামের আব্দুল মালেকের স্ত্রী নাজমা বেগম বলেন, তাঁর স্বামী কৃষিকাজ করেই পাঁচজনে সংসার চালাতেন। কিন্তু মজুরি কম পাওয়ায় কৃষি ছেড়ে পাথর ভাঙা মেশিনে কাজ শুরু করেন। কাজ শুরুর তিন বছরের মাথায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা নিয়ে ২০১৬ সালে মারা যান। এখন তিনি তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। 

সালাম, মালেকসহ হাজারো পাথরভাঙার শ্রমিকদের জীবনের গল্প একই রকম; তীব্র যন্ত্রণা আর অভাবে বিপর্যস্ত। নাজমার মতো অনেক গৃহবধূ স্বামী হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এই পর্যন্ত সিলোকিসেসে আক্রান্ত হয়ে ৬০ জন পাথর ভাঙার যন্ত্রের শ্রমিক মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন বুড়িমারী স্থলবন্দর পাথর ভাঙা শ্রমিক সুরক্ষা কমিটির সভাপতি মমিনুর রহমান। তিনি দাবিকরেন, এখন সিলোকোসিসে আক্রান্ত হয়ে ৫০ জন শ্রমিক গুরুতর অসুস্থ। বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু সাইদ নেওয়াজও একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, গত ১৩ বছরে সিলিকোসিসে ৬০ জন পাথর ভাঙার শ্রমিক মারা গেছেন। বর্তমানে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৩০। এর মধ্যে ২০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। 

>লালমনিরহাটের পাটগ্রামে পাথর ভাঙার যন্ত্রে কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকেরা সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ পর্যন্ত ৬০ জন শ্রমিক মারা গেছেন।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (স্বাস্থ্য) চিকিৎসক নাজমুন নাহার বুড়িমারীতে ২০১৭ সালে চিকিৎসা শিবির পরিচালনা করেছেন। তিনি জানালেন, পাথর ভাঙার শ্রমিকদের পাশাপাশি পাথর ভাঙার যন্ত্র যেখানে বসানো হয়েছে তার আশপাশের বসতবাড়ির মানুষ সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই এই সমস্যা সমাধানে মাস্ক ব্যবহারসহ অন্যান্য প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া খোলা আকাশের নিচে পাথর ভাঙার মেশিন না চালানোর জন্য তাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন।

২০১২ সালে বুড়িমারীতে প্রথম সিলিকোসিস রোগ নিয়ে জরিপ চালায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)। বিলসের গবেষণায় যুক্ত স্কয়ার হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী বিশেষজ্ঞ ফজলে রাব্বী মোহাম্মদ বলেন, পাটগ্রামের বুড়িমারীতে বিভিন্ন কারখানায় যে পাথর গুঁড়া করা হয়, তাতে কোয়ার্টজ ও লাইমস্টোনের পরিমাণ বেশি। এখানে ছোট ছোট আবদ্ধ ঘরে পাথর গুঁড়া করার কাজ চলছে। এতে শ্রমিকদের সারা শরীর পাথরের গুঁড়া সাদা হয়ে যায়। এখানে যারা কাজ করছেন, তাঁদের ফুসফুসে বেশি পরিমাণে সিলিকা যাচ্ছে। এসব গুঁড়া যখন বেশি জমে যায়, তখন ফুসফুস তার কার্যক্ষমতা হারায়। এ কারণে শ্রমিকেরা স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারেন না।

বুড়িমারী স্থলবন্দর পাথর ভাঙা শ্রমিক সুরক্ষা কমিটির সভাপতি মমিনুর রহমান বলেন, স্থলবন্দর এলাকায় ২০০১ সালে এসব পাথর ভাঙার কাজ শুরু হয়। প্রথম দিকে ভবন বা টিনের ঘরের মধ্যে চুনাপাথর ও কোয়ার্টজ ভাঙা হতো। ২০১০ সালের দিকে খোলা আকাশের নিচে পাথর ভাঙা শুরু হয়। এই পাথরের গুঁড়া মাছ ও মুরগীর খাবার এবং প্রসাধনসামগ্রী, ভবন ও রাস্তা তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। এসব পাথর বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা ভুটান ও ভারত থেকে আমদানি করছেন। পাটগ্রামে এখন ভবন বা টিনের ঘরে ১০টি পাথর ভাঙার কারখানা এবং খোলা আকাশের নিচে পাঁচ শতাধিক পাথর ভাঙার যন্ত্র আছে। এখানে প্রক্রিয়াজাত করা পাথর ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে।

সিলিকোসিস রোগ প্রতিরোধ সমন্বয় কমিটি, পাটগ্রামের আহ্বায়ক ও পাটগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রুহুল আমিন দাবি করেন, সিলিকোসিসে আক্রান্তের সংখ্যা এখন ৭০-৮০ শতাংশ কমে গেছে। তাঁরা পাথর ভাঙার যন্ত্রের শ্রমিকদের মধ্যে নিয়মিত সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

তবে এই বিষয়ে বিলসের সাবেক গবেষণা সমন্বয়ক আফজাল কবির খান প্রথম বলেন, বুড়িমারীতে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শ্রমিকেরা মাস্ক ছাড়া পাথর ভাঙার কাজ করছেন। শুধু পাথর ভাঙার শ্রমিক নয়, এই ধুলা পথচারী এবং আশপাশের বসতবাড়ির মানুষের শরীরেও ঢুকছে। তিনি অভিযোগ করেন, স্থানীয় প্রশাসন এবং বিলসের প্রস্তাবে ২০১৩ সালে গঠিত সিলিকোসিস রোগ প্রতিরোধ সমন্বয় কমিটি, পাটগ্রাম যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় এখনো শ্রমিকেরা এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মারা যাচ্ছেন।

আরও পড়ুন: