স্বেচ্ছাসেবা ছাড়া সবকিছুতে আগ্রহ স্বেচ্ছাসেবক লীগের

স্বেচ্ছাসেবক লীগ
স্বেচ্ছাসেবক লীগ

স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বিনা বেতনে যে ব্যক্তি সেবা দান করেন, তিনি স্বেচ্ছাসেবক। তবে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাদের সেদিকে আগ্রহ নেই। তাঁদের আগ্রহ রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে ব্যবসা-ঠিকাদারিসহ টাকা কামাইয়ের নানা কার্যক্রমে। সে কারণে দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় তাঁদের সেবা দিতে দেখা যায় না। এর নেতাদের দাবি, তাঁরা দলীয় কর্মসূচিতে সেবা দেন।

আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্র, মহানগর ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমনটা জানা গেছে। তাঁরা বলেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ মূলত সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের পুনর্বাসনকেন্দ্র। এ সংগঠনের প্রায় ৯৫ শতাংশ নেতা ছাত্রলীগ থেকে আসা। ছাত্রলীগ থেকে বের হওয়ার পর যুবলীগ বা আওয়ামী লীগের কমিটিতে যেতে মাঝখানে লম্বা সময় পরিচয়হীন থাকতে হতো আগে। এই সময়টায় তাঁরা স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতি করেন।

রাজধানী ঢাকায় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা আছেন প্রায় আট হাজার। সারা দেশে জেলা, থানা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন মিলে সংগঠনের নেতার সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের বেশি। এখন প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে এ সংগঠন। এসব কমিটি হয়ে গেলে নেতার সংখ্যা ১৮ লাখ ছাড়াবে। স্বেচ্ছাসেবক লীগের মতোই রাজধানীতে কৃষক লীগের পদধারী নেতাই আছেন প্রায় ৮ হাজার। যদিও এখানে কোনো কৃষিজমি বা কৃষক নেই।

স্বেচ্ছাসেবক লীগ কী করে, জানতে চাইলে এর কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের সমাবেশে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেন তাঁরা। আওয়ামী লীগের যেকোনো কর্মসূচি, বিভিন্ন দিবসে কর্মসূচি পালন করেন তাঁরা। এবার বন্যায় ত্রাণ ও ডেঙ্গু সচেতনতায়ও কাজ করেছে বলে দাবি করেন এর নেতারা, তবে সেটা খুব দৃশ্যমান ছিল না। যদিও এ দুটি বিষয় ছিল আওয়ামী লীগের ঘোষিত কর্মসূচি।

>স্বেচ্ছাসেবক লীগে সাড়ে তিন লাখের বেশি নেতা।
ক্যাসিনো-কাণ্ডে আলোচিত সংগঠনের সভাপতি।
পরিবহন ব্যবসায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক।

আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকার উদ্দেশ্য নিয়ে জন্ম নিয়েছিল স্বেচ্ছাসেবক লীগ। তবে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক পংকজ নাথ প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডই তাঁদের মুখ্য কাজ। তিনি বলেন, ‘আমরা তো সেবা দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষিত শক্তি নই। আমরা রাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবক।’

স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসার। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসার। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

ক্যাসিনো আলোচনায় সভাপতি
২০১৫ সালে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর আরামবাগের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো চালু করেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। তাঁর আগে থেকেই এ ক্লাবের সভাপতির দায়িত্বে আছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসার। এ ক্লাবে র‍্যাবের অভিযানের পর ক্যাসিনো-কাণ্ডে মোল্লা কাওসারের সংশ্লিষ্টতার খবর ছড়িয়ে পড়ে। যদিও তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, খেলাধুলার ক্লাব হিসেবেই তিনি যুক্ত ছিলেন। ক্যাসিনো বিষয়ে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না।

এদিকে চলমান অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার জি কে শামীমের সঙ্গেও মোল্লা কাওসারের ঘনিষ্ঠতার খবর জানা গেছে একাধিক সূত্রে। একচেটিয়া গণপূর্ত বিভাগের কাজের দরপত্র নিয়ন্ত্রণে জি কে শামীমকে সহযোগিতা করার অভিযোগ আছে মোল্লা কাওসারের বিরুদ্ধে। অস্ত্র ও মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় রিমান্ড শুনানির জন্য ২ অক্টোবর দ্বিতীয় দফায় আদালতে নেওয়া হলে মোল্লা কাওসারের খোঁজ করেন জি কে শামীম। তাঁর আইনজীবীদের কাছে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘মোল্লা কাওসার কোথায়? সে আসেন নাই?’ ওই সময় একজন উত্তর দেন, ‘উনি তো নিজেই দৌড়ের ওপরে আছেন। উনি কী করে আসবেন!’

এ বিষয়ে মোল্লা কাওসার প্রথম আলোকে বলেন, জি কে শামীম কেন তাঁকে খোঁজ করেছেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। তবে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে অনেকের সঙ্গেই পরিচয় থাকতে পারে।

স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পংকজ নাথ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পংকজ নাথ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

পরিবহন ব্যবসায় সাধারণ সম্পাদক

আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর ২০০৯ সালে ঢাকায় পরিবহন ব্যবসা শুরু করেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পংকজ নাথ। বিহঙ্গ নামে পরিচালিত তাঁর পরিবহন একটি রুট নিয়ে শুরু করে ব্যবসা। গত বছর পর্যন্ত ৫টি রুটে ২৪০টি বাস চলছে তাঁর কোম্পানির।

স্বেচ্ছাসেবকদের ঠিকাদারি
স্বেচ্ছাসেবকদের ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে ঠিকাদারি পেশা। সারা দেশেই এ সংগঠনের নেতারা বিভিন্ন ক্ষেত্রের ঠিকাদারির সঙ্গে জড়িত। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (সিভিল এভিয়েশন) উন্নয়নকাজে যে তিনজন ঠিকাদার সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন, তাঁদের একজন হলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মতিউর রহমান ওরফে মতি। আরেক সহসভাপতি ম. আবদুর রাজ্জাক পানি উন্নয়ন বোর্ড ঠিকাদার সমিতির সভাপতি। সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল আলিম পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে ঠিকাদারি করেন।

ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোবাশ্বের হাসান চৌধুরী ঢাকা উত্তর সিটির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। উত্তর সিটি করপোরেশনে ঠিকাদারি করেন তিনি। একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফরিদুর রহমান খান হলেন ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। খামারবাড়ির বিভিন্ন কার্যালয়ে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। ঢাকা দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি দেবাশীষ বিশ্বাস ও সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমানও ঠিকাদারী-বাণিজ্যে যুক্ত বলে জানা গেছে। আরিফুর রহমান উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডিরও সভাপতি।

বিদেশে শাখা খোলায় আগ্রহ
বিদেশে শাখা খোলায় বাড়তি আগ্রহ দেখা গেছে স্বেচ্ছাসেবক লীগের। যেসব দেশে প্রবাসী বেশি, সেখানেই শাখা খুলেছে স্বেচ্ছাসেবক লীগ। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ইতালিসহ ১৫টি দেশে শাখা আছে স্বেচ্ছাসেবক লীগের। বিদেশে শাখা খোলার বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পংকজ নাথ প্রথম আলোকে বলেন, সংগঠনের সভাপতি বিভিন্ন দেশ সফরের সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে বিদেশ কমিটি করেছেন।

মূল জায়গায় নেই
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪-দলীয় জোটের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, স্বেচ্ছায় সেবা দেওয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবক লীগ করা হয়েছিল। কিন্তু এ সংগঠনও ছাত্রলীগ, যুবলীগের মতো হয়ে গেছে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে মূল জায়গা থেকে সরে গেছে। এটিকে মূল জায়গায় ফিরিয়ে আনা দরকার।

২৫ বছরে সম্মেলন দুবার
স্বেচ্ছাসেবক লীগের জন্ম ১৯৯৪ সালে। এরপর আহ্বায়ক কমিটি পার করে দেয় ৯ বছর। ২০০৩ সালে প্রথম কমিটি হয় সংগঠনটির। এর ৯ বছর পর ২০১২ সালে হয় দ্বিতীয় কমিটি। ৭ বছর পর এখন হতে যাচ্ছে তৃতীয় সম্মেলন। গঠনতন্ত্র অনুসারে তিন বছর পরপর সম্মেলন করার কথা থাকলেও গত ২৫ বছরে হয়েছে মাত্র দুটি। ঢাকা মহানগরের বর্তমান দুটি কমিটির বয়স ১৩ বছর। বিভিন্ন থানা ও জেলা কমিটি পার করে দিয়েছে ১৫ থেকে ১৬ বছর। গত ৭ বছরে ৭৯টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৪৫টি কমিটি নতুন করে করতে পেরেছে বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি।

প্রসঙ্গত, ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বিভাগ ছিল। যার প্রধান ছিলেন প্রয়াত কেন্দ্রীয় নেতা আবদুর রাজ্জাক।

সাংসদ হয়েছেন আটজন
স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতিতে থেকে এ পর্যন্ত সাংসদ হয়েছেন আটজন। এ সংগঠনের নেতাদের মধ্যে প্রথম সাংসদ হন সংগঠনের প্রথম কমিটির আহ্বায়ক মকবুল হোসেন। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে ঢাকার অন্যতম আলোচিত-সমালোচিত সাংসদ ছিলেন তিনি। ২০০১-এর নির্বাচনে তিনি জিততে পারেননি। এরপর আর নির্বাচন করা হয়নি তাঁর। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন (নাছিম), সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার, সাইমুম সরওয়ার (কমল), আশেক উল্লাহ স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা ছিলেন। এঁরা সবাই সাংসদ ছিলেন বিভিন্ন সময়। সংরক্ষিত আসনে সাংসদ হয়েছিলেন এ সংগঠনের উম্মে রাজিয়া (কাজল)। বর্তমান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন একসময় স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। তবে এ সংগঠনের নেতাদের মধ্যে বর্তমানে সংসদে আছেন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক পংকজ নাথ।

লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রথম আলোকে বলেন, দুর্যোগ বা মানবতার সেবার জন্য মূল দলেই দায়িত্বশীল নেতা আছেন। এরপরও আরেকটা সংগঠন করে কিছু লোকের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এঁরা দলের লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করেন। জাতীয় রাজনীতিতে তাঁদের কোনো ভূমিকা নেই। তাঁরা রাজনৈতিক পদ ব্যবহার করে ফায়দা আদায় করে নেন।