কখনো তারা পুলিশ, ব্যাংকার, বিমানমালিক

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভোরে ছেলেকে বাহরাইনের বিমানে উঠিয়ে দিয়ে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন আবুল বাশার। এর কয়েক ঘণ্টা পর চলতি পথেই একটি অপরিচিত নম্বর থেকে তাঁর মুঠোফোনে কল আসে। বাশার তখন চাঁদপুরগামী লঞ্চে। ফোনের ওপাশ থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভেসে আসে, ‘আব্বা আমি আবদুল কাদের। এয়ারপোর্ট থেকে বলছি...।’

ঘটনাটি ২০১৭ সালে মার্চের। হুবহু আবদুল কাদেরের কণ্ঠ নকল করে বাশারকে ফোন দিয়েছিলেন জাভেদ হোসেন নামের এক প্রতারক। তাঁর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ৩০ হাজার ৬০০ টাকা খোয়ান বাশার। পরে বাশারের পরিবারেরই করা এক মামলায় জাভেদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরপর বেরিয়ে আসে জাভেদের প্রতারণার চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

ছেলেকে বাহরাইন পাঠাতে ধার করে তিন লাখ টাকা খরচ করেন কৃষক আবুল বাশার। সম্প্রতি মুঠোফোনে প্রতারণার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘সেদিনের ওই কলে হুবহু আমার ছেলের কণ্ঠে বলা হয়, “আব্বা আমি বিমানের টিকিট আর মোবাইল হারায়ে ফেলছি। এখন টাকা পাঠালে আবার টিকিট কেটে বিদেশ যেতে পারব, না দিলে যাওয়া হবে না।” সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ওই নম্বরে আবার ফোন দিলে নিজেকে ইমিগ্রেশন পুলিশ পরিচয় দিয়ে কাদের সম্পর্কে একই কথা জানায়।’

এরপর দুটি বিকাশ নম্বরে ৩০ হাজার ৬০০ টাকা পাঠান বাশারের ভাগনে মাহফুদুল হাসান। ওই দিনই রাতে কাদের বাহরাইন পৌঁছে পরিবারের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেন। টাকা পাঠানোর বিষয়টি শুনে কাদের জানান, টিকিট কিংবা ফোন হারানোর মতো কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তখন আবুল বাশারও বুঝতে পারেন প্রতারণার শিকার হয়েছেন তাঁরা।

পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, বিভিন্ন কায়দায় এমন প্রতারণার ঘটনা সারা বছরই লেগে থাকে। সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অল্প সময়ের ব্যবধানে কোটি টাকার মালিক বনে যায় প্রতারকেরা। সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, শুধু চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে ৭৮১টি প্রতারণার মামলা হয়েছে। যাতে ভুক্তভোগীর সংখ্যাও কয়েক হাজার।

যেভাবে প্রতারণা করতেন জাভেদ
বিমানবন্দরের ওই প্রতারণার ঘটনায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তকারী কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম বলেন, জাভেদকে এ কাজে সহায়তা করতেন সিরাজুল ইসলাম, ইউসুফ আলী ও মেহেদি নামের আরও তিনজন। এর মধ্যে জাভেদ ও সিরাজুল বিমানবন্দরে দর্শনার্থীদের ভেতরে প্রবেশের গেটে টিকিট চেকিংয়ের দায়িত্বে থাকা একটি প্রতিষ্ঠানের সিকিউরিটি গার্ড। বিদেশগামী যাত্রীর এমবারকেশন (ইডি কার্ড) ফরম পূরণের সময় সহায়তার অজুহাতে গোপনে যাত্রীর ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করতেন। যাত্রী বিমানে ওঠার পর তাঁদের মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হলে জাভেদ যাত্রীর স্বজনদের ফোন দিতেন। কখনো যাত্রী সেজে আবার কখনো ইমিগ্রেশন পুলিশ পরিচয় দিয়ে যাত্রীর বিপদের কথা বলে জরুরি ভিত্তিতে টাকা চাইতেন। টাকা না দিলে যাত্রা বাতিল হওয়ারও ভয় দেখাতেন।

জাভেদকে যাতে শনাক্ত করা না যায়, এই জন্য তাঁকে নিবন্ধনহীন সিমে বিকাশ অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার কাজ করতেন গাজীপুরের বিকাশ এজেন্ট মেহেদি ও ইউসুফ। এইভাবে এই চক্র এক হাজারের বেশি যাত্রীর স্বজনের সঙ্গে প্রতারণা করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

সিআইডির হয়ে বিভিন্ন প্রতারণার মামলা পর্যালোচনার কাজ করেছেন পুলিশের অতিরিক্ত বিশেষ সুপার মিনহাজুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মানুষের মাঝে তথ্য বিনিময়ের প্রবণতা বাড়ার কারণে বিকাশ, চাকরির বিজ্ঞাপন, ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট, মুঠোফোন নম্বর স্পফিং, লটারি জেতাসহ বিভিন্ন কৌশলে প্রতারণা প্রতিদিনই ঘটছে। এ ক্ষেত্রে অশিক্ষিত মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষিত মানুষও ফাঁদে পড়ছেন। কিছুটা লোভ আর অসাবধানতার কারণে প্রতারকদের হাতে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

আমেরিকায় তিনি বিমানের মালিক
কয়েক দিন পরপরই জুতা আর পোশাক কিনতে ঢাকার নামীদামি বিপণিবিতানে যেতেন আলতাফ হোসেন। কিনতেন দোকানে থাকা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সবচেয়ে দামি পণ্য। এক-দুই নয়, তিরিশ-চল্লিশ জোড়া। এরপরও এক পণ্য বেশি দিন ব্যবহার করতে পারেন না, তাই মাসে অন্তত তিন–চারবার পণ্য কিনতে যেতেন ওই সব দোকানে। এভাবেই সখ্য গড়ে উঠত দোকানের কর্মচারীদের সঙ্গে। এরপর তাদের শোনাতেন নিজের বিলাসবহুল জীবনের গল্প। আমেরিকায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি, আছে নিজস্ব বিমান সংস্থা, যেগুলোতে বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ কাজ করেন।

সখ্য গড়ে ওঠার পর প্রথমে আলাপের ছলে নিজের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার কথা বলতেন। তাতে কেউ আকৃষ্ট হলেই ভিসা, টিকিটের কথা বলে কয়েক দফায় টাকা হাতিয়ে নিতেন। তাঁকে এ কাজে সহায়তা করতেন শরীফুল নামের আরেকজন।

চলতি বছরের জুলাইয়ে আলতাফকে গ্রেপ্তারের পর সিআইডি জানায়, আলতাফ ডিগ্রি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর ১০ বছর ধরে এই প্রতারণার কাজ করেছেন। তিনি নিজে কখনো আমেরিকায় যাননি। কিন্তু মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য আমেরিকায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, বিমানমালিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ এমনকি বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা বলতেন।

আলতাফের প্রতারণার শিকার হন খুলনার ঠিকাদার রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, আলতাফের গল্প শুনে সত্য–মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য পরিচিত আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তাঁরাও আলতাফের মাধ্যমে আমেরিকা যাওয়ার জন্য টাকা জমা দেওয়ার কথা জানান। এরপর কয়েক দফায় আলতাফকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা দেন ব্যাংক ও বিকাশের মাধ্যমে।

ব্যাংক না তবুও ব্যাংক
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে ২০০৩ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত নিজে একটি সমবায় প্রতিষ্ঠানে পরিচালক হিসেবে কাজ করতেন শামীম কবির। বেতন পেতেন ৫০ হাজার টাকা। ২০০৬ সালে নিজেই একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান চালু করেন। এরপর মাত্র ৬ বছরে ৫০ হাজার টাকা বেতনের কর্মকর্তা থেকে ৩০০ কোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি। শামীম কবিরের (৪৫) বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। সেখানেই প্রথম স্থানীয়ভাবে চালু করেন তাঁর সমবায় প্রতিষ্ঠান ফারইস্ট ইসলামি মাল্টি কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড। 


তাঁকে গ্রেপ্তারের পর সিআইডি জানায়, গ্রাহককে নির্দিষ্ট টাকার ওপর লভ্যাংশ দেওয়ার কথা বলে ফারইস্টের মাধ্যমে প্রায় ২০ হাজার গ্রাহকের কাছে থেকে ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন শামীম। প্রতারণার জন্য তিনি সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগাতেন। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে সাজানো অফিসে মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিভিন্ন বাণী শোনাতেন। তাঁর প্রতারণার শিকার হন ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রামের প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকার মানুষ।

ভুক্তভোগী ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মঈনুদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘নিজের বেতন ও স্ত্রীর পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে প্রায় ৭০ লাখ টাকা জমা করেছিলাম। একটিবারের জন্যও ভাবিনি, এমনটা হতে পারে। কিছু বাড়তি টাকার জন্য কত বড় বোকামি করেছি, তা এখন বুঝতে পারছি।’

পুলিশের অতিরিক্ত বিশেষ সুপার মিনহাজুল ইসলাম বলছেন, প্রতারণার হাত থেকে বাঁচতে মানুষকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত তথ্য বিনিময়ে সচেতন হতে হবে। কারণ এসব জায়গা থেকেই প্রতারকেরা তথ্য সংগ্রহ করে তা কাজে লাগায়। তাই সন্দেহজনক কিছু মনে হলে আগে পুলিশকে জানানো উচিত।