ঝুঁকিপূর্ণ আবরার পদচারী-সেতু

ওপরে আবরার পদচারী–সেতু। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে নিচ দিয়ে পারাপার চলছেই। গতকাল যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে।  ছবি: প্রথম আলো
ওপরে আবরার পদচারী–সেতু। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে নিচ দিয়ে পারাপার চলছেই। গতকাল যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে। ছবি: প্রথম আলো

রাস্তা পারাপারে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে নির্মাণ করা হয়েছিল পদচারী–সেতু। কিন্তু সেটিই এখন ঝুঁকিতে পড়েছে। ধরা পড়েছে নির্মাণে ত্রুটি। কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। অথচ ত্রুটিপূর্ণ সেতুতেই চলন্ত সিঁড়ি লাগানোর চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে প্রগতি সরণিতে নির্মিত আবরার পদচারী–সেতুর এই অবস্থা। নির্মাণ–পরবর্তী মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নির্মাণে ত্রুটির বিষয়টি। চলতি বছরের ১৯ মার্চ যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বাসের চাপায় নিহত হন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী। এ ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসেন। তখন দুর্ঘটনাস্থলে আবরারের নামে পদচারী–সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।

পিইবি স্টিল নামের একটি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ইফাত জাহান প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে তাঁদের যেভাবে নকশা দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা সেভাবেই এটি নির্মাণ করেছেন। ঝুঁকিপূর্ণ সেতুতে চলন্ত সিঁড়ি বসানোর বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

গত সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এই সেতু পারাপারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। নির্মাণকাজ শেষে স্থাপনার অবকাঠামোগত কোটি ত্রুটি
আছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিকে (এমআইএসটি) দায়িত্ব দেয় ডিএনসিসি। এমআইএসটির সেন্টার পর অ্যাডভাইজরি অ্যান্ড টেস্টিং সার্ভিস সেতুটি পরীক্ষা করে গত ২৭ অক্টোবর একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্টিলের তৈরি এই সেতুর মেঝে পাতলা স্টিলের পাত দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। সেতুর মাঝখানে বিচ্যুতি ও কম্পন বেশি মাত্রায় দেখা গেছে। পুরো সেতুর কাঠামো নাটবল্টু দিয়ে যুক্ত। এ ধরনের কলামভিত্তিক সেতুতে নাটবল্টুর পরিবর্তে ‘এঙ্কর বোল্ড’ বা ভবনের মতো কলাম দিয়ে তৈরি করতে হয়।

এমআইএসটির পরিদর্শক দল সেতুতে বেশ কয়েকবার পারাপার করে দেখেছে, সাধারণত পদচারী–সেতুতে মানুষ যে গতিতে হাঁটে, এখানে তার চেয়ে অনেক বেশি গতিতে লোকজন এই সেতু পার হচ্ছে। পারাপারের সময় সেতুটি বেশি মাত্রায় কেঁপে উঠছে। এই কম্পনের মাত্রা এতটাই বেশি যে পদচারীরা স্বস্তিতে সেতু হয়ে পার হতে পারছে না।

এমআইএসটির ওই প্রতিবেদনে কয়েকটি সুপারিশও করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সেতুটির স্তম্ভ ঘন ঘন কেঁপে ওঠে। এই কম্পন বন্ধ করার জন্য স্তম্ভ মজবুত করতে হবে। সেতুর কলামও মজবুত করতে হবে। বর্তমানে পদচারী–সেতুটি ব্যবহার করা যাচ্ছে, তবে এটিকে নিয়মিত তদারকিতে রাখতে হবে। কারণ, সেতুটি ধারণক্ষমতার তুলনায় অফিস চলাকালীন বেশি ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমান সেতুটির হয় আকার বাড়াতে হবে, নাহয় পাশাপাশি আরেকটি সেতু নির্মাণ করতে হবে। বর্তমান অবকাঠামো অক্ষত রেখে সংস্কারের পর এটি চলাচলের উপযোগী কি না, তা আবারও পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

ডিএনসিসি এলাকায় পদচারী–সেতু নির্মাণের বিষয়টি দেখভাল করে ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল। আবরার পদচারী–সেতুর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফরহাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আরিফুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরে আরিফুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলে তিনি ধরেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও এর জবাব দেননি।

ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের আরেকজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ এই সেতু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন করপোরেশনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। এমআইএসটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগেই চলন্ত সিঁড়ি কেনা হয়েছে। এখন ঝুঁকিপূর্ণ সেতুতে চলন্ত সিঁড়ি কীভাবে বসানো যায়, এ নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। কারণ, সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানও সেখানে চলন্ত সিঁড়ি যুক্ত না করতে বলছে। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, চলন্ত সিঁড়ি হয়ে কেবল ওপরে ওঠা যাবে। নিচে নামার ব্যবস্থা থাকবে না। এতে ওপরে ওঠা লোকজনের ব্যাপক চাপ পড়বে। তখন দ্রুত নিচে না নামতে পারলে ঝুঁকি আরও বাড়বে। এসব ঝুঁকি বিবেচনায় চলন্ত সিঁড়ি স্থাপনা করা না হলে তা ফেলে রাখতে হবে।

ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আবরার পদচারী–সেতুটি যে প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে, তারা এর আগে এমন সেতু তৈরি করেনি। ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল সঠিকভাবে তাদের দিকনির্দেশনা না দেওয়ার কারণে সেতু নিয়ে গোটা করপোরেশনে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আপাতত বড় ধরনের ঝুঁকি এড়াতে এই সেতুর নিচ দিয়েও রাস্তা পারাপারের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, আবরার পদচারী–সেতু পারাপারে প্রায় দীর্ঘ সারির সৃষ্টি হচ্ছে। লোকজনের চাপ বেশি হওয়ায় অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে সড়ক দিয়েই পারাপার হচ্ছে। কেবল সেতুর নিচ দিয়েই নয়, সেতুর উত্তর দিকে যমুনা ফিউচার পার্কের মূল ফটকের সামনের সড়ক হয়েও রাস্তা পারাপারের জন্য পথ খুলে দেওয়া হয়েছে। ওই পথ হয়েছে লোকজন রাস্তা পার হচ্ছে। এতে করে এই এলাকায় আগের মতো যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাঈদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবরার পদচারী–সেতু নির্মাণে তেমন বড় ত্রুটি নেই। একটু হালকা করে তৈরি করেছে। এটাকে সংস্কারের চিন্তাভাবনা করছি। চলন্ত সিঁড়ি সরাসরি সেতুর সঙ্গে যুক্ত হবে না। কিছুটা দূর থেকে যুক্ত হবে। চলন্ত সিঁড়ির কম্পন্ন মূল পদচারী–সেতুতে প্রভাব ফেলবে না।’