ধ্রুবতারায় স্বপ্ন বুনছেন তাঁরা

সাত নারী। অনেক স্বপ্ন নিয়ে সৌদি আরব গিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ তো হয়নি, বরং সেখান থেকে নির্যাতনের শিকার ও তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছেন গৃহকর্মীর চাকরি নিয়ে যাওয়া ওই সাত নারী। এখন তাঁরা নতুন করে স্বপ্ন বুনছেন। শুরু করেছেন খাবারের ব্যবসা। নাম ধ্রুবতারা ক্যাটারিং সার্ভিস।

গত রোববার সকালে দক্ষিণখানে ধ্রুবতারার ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, কাজে ব্যস্ত তাঁরা। রান্না শেষে কেউ ডাল প্যাকেট করছেন, কেউ বা মুরগির ঝোল। গরম ভাত, ডাল আর মুরগির ঝোল ৭০টি বাক্সে ভরা শেষ হলে তা বড় বড় ব্যাগে ঢোকানো হলো। এক ফাঁকে নিজেরাও খেয়ে নেন তাঁরা। এরপর বেলা ১১টার মধ্যে ব্যাগগুলো নিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশাযোগে গন্তব্যে রওনা দেন। বনানী, খিলক্ষেত, উত্তরা, বিমানবন্দরসহ আশপাশের বিভিন্ন অফিস অথবা মার্কেটে আসা লোকজনের কাছে তা বিক্রি করবেন।

হাতের কাজ গোছাতে গোছাতে একজন বললেন, ‘মানুষের মুখের দিকে তাকাই থাকি। বাটি নিয়া ঘুরতে থাকি। খালি চিন্তা করতে থাকি, সব বিক্রি হইব তো? খাবার বিক্রির পর বাটি ফেরত দিলে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হইয়্যা যায়। আসার পর আবার রাইতের খাওনের ব্যবস্থা করি। এই করতে করতে দিন রাইত কোন দিক দিয়া পার হইয়্যা যায় বুঝতেও পারি না।’

পাশ থেকে আরেকজন বললেন, ‘কষ্ট বেশি হইলেও এখন আমরা ভালা আছি। সৌদিতে যে নির্যাতনের শিকার হইছি, সেই তুলনায় এই কষ্ট তো কিছুই না।’

বিদেশফেরত নারী শ্রমিকদের পুনর্বাসনের এ উদ্যোগে সহায়তা করেছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। গত অক্টোবর থেকে ধ্রুবতারা ক্যাটারিং সার্ভিস চালু হয়েছে। আর গত বছরের বিভিন্ন সময় ব্র্যাকের আবেদনে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় এই নারীরা দেশে ফিরেছেন। আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি বাড়ি ভাড়া করে দেওয়া, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়াসহ সার্বিক সহায়তা করছে ব্র্যাক। ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে যে আয় হচ্ছে, তা সাতজন নারী সমান ভাগ করে নিচ্ছেন। এমনকি প্রতিষ্ঠানের নিট মুনাফা থেকে ২ শতাংশ তাঁরা জমা করছেন তাঁদের মতো ফেরত আসা নারী শ্রমিকদের জন্য।

চলছে খাবার প্যাকেট করার কাজ। গত মঙ্গলবার দক্ষিণখানে ধ্রুবতারার ভাড়া ঘরে।
চলছে খাবার প্যাকেট করার কাজ। গত মঙ্গলবার দক্ষিণখানে ধ্রুবতারার ভাড়া ঘরে।

এক বছর বয়সী মেয়েকে নিয়েই ক্যাটারিং সার্ভিসের খাবার বিক্রি থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজ করছেন এক নারী। জানালেন, সৌদিতে যাওয়ার পর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দেশে ফেরার পর স্বামীর ঘরে জায়গা হয়নি। এখন আশ্রয় এই ধ্রুবতারা।

ধ্রুবতারার ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ২৩ বছর বয়সী ডালিয়া আক্তার। সৌদি আরবে ১৪ মাস থাকার পর নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে পালানোর জন্য তিনতলা থেকে লাফ দিয়েছিলেন। হাসপাতালে দুই মাস আর বাংলাদেশ সরকারের সেফহোমে চার মাস থাকার পর গত বছরের আগস্টে দেশে ফিরেছেন। চার মাস আগে স্বামী চার বছর বয়সী ছেলেকে নিজের কাছে রেখে তাঁকে বের করে দিয়েছেন।

ধ্রুবতারার সদস্যরা জানালেন, ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে পরিমাণে কম হলেও লাভ হচ্ছে। তবে অফিস বা মার্কেটে খাবারের নির্দিষ্ট ক্রেতা থাকলে কষ্টটা একটু কমত। খাবারের ফরমাশ নেওয়ার জন্য একটি হটলাইন নম্বর (০১৭৪১৫১৩৩৩০) চালু করেছে ধ্রুবতারা।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান জানালেন, ক্যাটারিং সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত নারীদের ব্র্যাকের পক্ষ থেকে এককালীন প্রায় চার লাখ টাকাসহ বিভিন্ন সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এখনো ব্র্যাকের স্বেচ্ছাসেবকেরা এই নারীদের পাশে আছেন। তবে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নির্যাতন ও তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফেরা নারীদের তুলনায় এ উদ্যোগ খুবই সামান্য। কিন্তু কিছু একটা তো শুরু হলো।