বিলম্বে হলেও করোনা মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার

রাস্তায় চলাফেরা না করার জন্য মাইকিং করছে পুলিশ। বাংলাবাজার, ঢাকা, ২৬ মার্চ। ছবি: দীপু মালাকার
রাস্তায় চলাফেরা না করার জন্য মাইকিং করছে পুলিশ। বাংলাবাজার, ঢাকা, ২৬ মার্চ। ছবি: দীপু মালাকার

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই মুহূর্তে করণীয় ছয়টি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশও এসব বিষয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে কিছু কাজ বাংলাদেশ আগেই শুরু করতে পারত বলে মনে করছেন অনেকে।

প্রায় ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা এখনো অনেক বাকি। এই পরীক্ষা হয়েছে মাত্র এক হাজার মানুষের। বাংলাদেশ কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল চিকিৎসা ও আইসোলেশনের জন্য পুরোপুরি তৈরি। ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর স্বল্পতা নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে অসন্তোষ আছে। কত মানুষ ইতিমধ্যে সংক্রমিত, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস আছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়া নিয়ে উদ্বেগ আছে প্রায় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। তবে সরকার তার মতো করে প্রস্তুতি নিয়ে চলেছে।

প্রস্তুতির ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, সরকার দেরিতে হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি দেওয়া, দেশের বিভিন্ন স্থান লকডাউন করা, লম্বা সরকারি ছুটি দেওয়া, পরীক্ষার আওতা বৃদ্ধি—এসব পদক্ষেপ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম ২৫ মার্চ নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ মুহূর্তে করণীয় ছয়টি বিষয়ের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, দ্বিতীয় সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশসহ ১৭৮টি দেশে এই ভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। প্রতিদিন অর্ধলক্ষাধিক মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে। বৈশ্বিক মহামারির এ পর্যায়ে ছয়টি বিষয়কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গুরুত্ব দিয়েছে। সংস্থার প্রথম সুপারিশে বলা আছে, জনস্বাস্থ্যসেবার আওতা বৃদ্ধি ও জনস্বাস্থ্য জনবলকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং তাদের কাজে নামাতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ চলছে। চিকিৎসকদের বিষয়টি যতটা আলোচনা হয়, অন্যান্য লোকবল বা প্রস্তুতি নিয়ে তত আলোচনা হয় না। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) র‌্যাপিড রেসপন্স টিমের সদস্যরা এবং আইইডিসিআরের কর্মীরা রোগ শনাক্ত করেন। ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে জনবল কম। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নমুনা সংগ্রহের জন্য সব জায়গায় মানুষ পাঠাতে পারছে না আইইডিসিআর।

অন্যদিকে গ্রাম পর্যায়ে সন্দেহভাজন রোগীদের নমুনা সংগ্রহে যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ এখনো শুরু হয়নি। এ ছাড়া হাসপাতালে সংক্রমণ প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও প্রশাসনের লোকদের এখনো প্রশিক্ষণ হয়নি।

সরকারের প্রস্তুতির ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে ছয়টি বিষয়ের বিস্তারিত তথ্য দিয়ে বলেছেন, ‘সরকারের প্রস্তুতি আগে থেকে ছিল এবং তা এখন আরও বেশি জোরদার হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিড-১৯ নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন ও পরামর্শ দিচ্ছেন।’ জনবল সম্পর্কে তিনি বলেন, ৬৪ জেলা পর্যায়ের এবং ১০০টি উপজেলার কর্মীদের ইতিমধ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ইপিআইয়ের মাঠকর্মীদের নমুনা সংগ্রহের কাজে লাগানো হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দ্বিতীয় সুপারিশ সমাজে বা জনগোষ্ঠীতে সন্দেহভাজন রোগী শনাক্তকরণ বিষয়ে। সংস্থাটি বলছে, কমিউনিটিতে থাকা প্রত্যেক সন্দেহভাজন রোগীকে খুঁজে বের করতে একটি পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে হবে।

এ ক্ষেত্রেও সরকারের প্রস্তুতি দুর্বল। সন্দেহভাজন রোগীদের খুঁজে বের করার কাজটি করছে আইইডিসিআর। পরীক্ষার পরিধি না বাড়ালে এই ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। আইইডিসিআর ঢাকার বাইরে সন্দেহভাজন রোগী খুঁজে বের করার জন্য কোন পদ্ধতি ব্যবহার করবে, তা এখনো স্পষ্ট করেনি।

অবশ্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) কাজে লাগানো হবে। সন্দেহভাজন ব্যক্তির ব্যাপারে সিএইচসিপিরা উপজেলা হাসপাতালে যোগাযোগ করবে। উপজেলা থেকে কর্মী গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করবে। নমুনা দেওয়ার জন্য কেউ হাসপাতালে যাবে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা। পরীক্ষার আওতা ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। পরীক্ষায় দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি সবার জন্য তা সহজলভ্য করতে হবে।

জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মাত্র ৯২০ জনের নমুনা পরীক্ষা করেছে আইইডিসিআর। মাত্র এক দিন আগে রাজধানীর জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও চট্টগ্রামের বিআইটিআইডি কেন্দ্রে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এত দিন শুধু রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) এই পরীক্ষা হতো। বাংলাদেশ অনেক দেরিতে পরীক্ষার আওতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগও যথেষ্ট নয়। তারপরও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশকে (আইসিডিডিআরবি) সরকার এই বিশেষায়িত কাজে যুক্ত করেনি। কেন করেনি তার উত্তর জানা যায়নি। অন্যদিকে গ্রাম পর্যায়ে পরীক্ষার কার্যক্রম এখনো শুরুই হয়নি। কবে নাগাদ শুরু হবে, তা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেন না।

রোগ শনাক্তকরণ কিটের কোনো সংকট হবে না মন্তব্য করে আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দ্রুত শনাক্তকরণ কিটের ব্যাপারেও যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চতুর্থ গুরুত্ব হচ্ছে, কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা ও তাদের আইসোলেশনে রাখার জন্য হাসপাতাল বা ক্লিনিক নির্দিষ্ট করতে হবে, সেগুলোকে ব্যবহার উপযোগী করতে হবে এবং যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সামগ্রী দিয়ে সাজাতে হবে।

এই চিকিৎসার জন্য সরকার রাজধানীতে আটটি হাসপাতাল নির্দিষ্ট করেছে। দুটি হাসপাতাল ছাড়া বাকিগুলো এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। নির্দিষ্ট এসব হাসপাতাল ছাড়াও সারা দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে কিছু সংখ্যক শয্যা পৃথক রাখা হয়েছে। তবে এসব হাসপাতালে ভেন্টিলেটর ও আইসিইউ সুবিধা পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই।

মহাপরিচালক বলেন, জেলা শহরের সদর হাসপাতালগুলোকে এ কাজে ব্যবহারের চেষ্টা চলছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পঞ্চম গুরুত্ব হচ্ছে, সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আশা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিন করার জন্য একটি স্পষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। কোন পদ্ধতিতে তা করা হবে, তা-ও পরিষ্কার করে বলতে হবে।

দেশে কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থাও সুবিধাজনক নয়। কাদের কোয়ারেন্টিন করা হবে তা সাধারণ মানুষের কাছে পরিষ্কার নয়। কোয়ারেন্টিন করা যায় দেশে এমন মানুষ আছে প্রায় চার লাখ। সরকারের তথ্য অনুযায়ী কোয়ারেন্টিনে আছে ৪০ হাজার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোভিড-১৯ বিষয়ক ১২টি নির্দেশনা তৈরি করেছে। কিন্তু কোয়ারেন্টিনবিষয়ক কোনো পরিকল্পনা ও নির্দেশনার কথা শোনা যায়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেছেন, সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী কোয়ারেন্টিন করা হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ষষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় গোটা সরকারব্যবস্থাকে সংযুক্ত ও সম্পৃক্ত হতে হবে। এটা শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার কাজ নয়।

সরকার দাবি করছে, সরকারের সব মন্ত্রণালয় করোনাভাইরাস মোকাবিলার কাজে যুক্ত হয়েছে। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে চীনের উহান থেকে ৩১২ জন বাংলাদেশিকে ফেরত আনার প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও পররাষ্ট্র, বিমান, ধর্ম মন্ত্রণালয় যুক্ত ছিল। এর পরদিন অন্যান্য মন্ত্রণালয়ও যুক্ত হয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠিত হয়। ৩ মার্চ এই কমিটির প্রথম সভা হয়েছিল। তবে এই কমিটির প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে ১৮ মার্চ।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, ইতিমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এ কাজে যুক্ত হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী এ কাজে সহায়তা করছে। বলা যায়, গোটা সরকার এখন মাঠে আছে।