ঝুঁকি নিয়েই মাঠে সক্রিয় পুলিশ

কোতোয়ালি থানা–পুলিশের উদ্যোগে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ করছেন পুলিশ সদস্যরা। গতকাল দুপুরে পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায়।  ছবি: দীপু মালাকার
কোতোয়ালি থানা–পুলিশের উদ্যোগে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ করছেন পুলিশ সদস্যরা। গতকাল দুপুরে পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায়। ছবি: দীপু মালাকার

পুলিশের যত কাজ

>
  • সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা। 
  • রাস্তায় জীবাণুনাশক ছিটানো। 
  • শ্রমজীবী মানুষকে সহায়তা করা। 
  • চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া।
  • কোয়ারেন্টিন থেকে পালানোদের খুঁজে বের করা।

 

রমনা থানায় ঢুকতেই মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস পরা কনস্টেবল ফয়েজ আহমেদ থামিয়ে দিয়ে বললেন, ওখানে সাবান-পানি আছে, আগে হাত ধুয়ে আসুন। দরজার মুখে ব্লিচিং পাউডার মেশানো পানিতে ভেজা বস্তা রাখা। সেখানে পা মুছে ভেতরে যেতে হবে। অভ্যর্থনাকক্ষে দুজন উপপরিদর্শক বসা, দুজনই পিপিই পরা। 

শুধু রমনা থানায় নয়, সারা দেশে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা করোনাভাইরাস থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখতে এভাবেই দায়িত্ব পালন করছেন। তবে পুলিশ সদস্যের ব্যবহার করা এসব মাস্ক, গ্লাভস এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর (পিপিই-পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট) খুব কমই সরকারিভাবে সরবরাহ করা। তাঁরা নিজেরাই এসব সংগ্রহ করছেন। আর পিপিই হিসেবে পুলিশ ব্যবহার করছে নিজেদের রেইনকোট।

মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা বলছেন, এত নিরাপত্তার পরও ব্যক্তিগত পরিচর্যা, অবসর, বিশ্রাম এবং ঘুমের সময় তাঁদের থাকতে হচ্ছে ঝুঁকিতে। তা ছাড়া মাঠে এসে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাও কঠিন হয়ে পড়ছে। কয়েকজন ইতিমধ্যে করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। ঝুঁকি এড়াতে তিন শতাধিক পুলিশ সদস্যকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। এ তালিকায় দুটি থানার সব পুলিশ সদস্যই আছেন।

পুলিশের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে পুলিশ কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে, সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে একটি কার্যতালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেটা সব পুলিশ সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে করোনা মোকাবিলায় ব্যক্তি সুরক্ষার সব ধরনের উপকরণও পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। নতুন মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

মাঠপর্যায়ের একাধিক পুলিশ সদস্য জানান, করোনা মোকাবিলায় পুলিশের কাজের তালিকা অনেক লম্বা। যেমন সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, রাস্তায় জীবাণুনাশক ছিটানো, শ্রমজীবী মানুষকে সহায়তা করা, সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করা, চিকিৎসা না পেয়ে থানায় হাজির হওয়া মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ঘরে থাকা মানুষের কাছে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পৌঁছে দেওয়া, কোয়ারেন্টিন থেকে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা, লকডাউন এলাকায় মানুষের যাওয়া-আসা নিয়ন্ত্রণ করা। এ ছাড়া করোনায় মৃতদের দাফনের ব্যবস্থাতেও পুলিশকে থাকতে হয়। গতকাল বুধবার পর্যন্ত দেশের ২৫ জেলা, ৪ উপজেলা এবং ঢাকা মহানগরের ৩৭ থানার অনেক এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। এসব জায়গায় নিরাপত্তার দায়িত্ব পুলিশের। ফলে স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি পুলিশকেও অনেক ঝুঁকিতে থাকতে হচ্ছে। কোথাও একজন আক্রান্ত হলেই পুরো দলটিকে কোয়ারেন্টিনে পাঠাতে হচ্ছে।

কিশোরগঞ্জের ভৈরব ও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানায় দুই পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় দুই থানার সব পুলিশ সদস্যকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা আক্রান্ত হওয়ার পর ২২ কর্মকর্তাকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়। গুলশান উপকমিশনারের কার্যালয়ে একজন সাধারণ কর্মচারী আক্রান্ত হওয়ার পর উপকমিশনারসহ ছয় কর্মকর্তা কোয়ারেন্টিনে গেছেন। রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাকে একজন সদস্য আক্রান্তের পর তাঁর পাশে থাকা আটজনকে আইসোলেশনে নেওয়া হয়েছে। ঢাকায় দাঙ্গা দমন বিভাগে (পিওএম) একজন আক্রান্তের পর একই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইনস ব্যারাকে একজন আক্রান্ত হওয়ার পর ব্যারাকে থাকা ২০০ পুলিশ সদস্যকে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যেও লোকজনকে ঘরে রাখতে বাসায় বাসায় বাজার, ওষুধ এবং হাসপাতালে রোগী পৌঁছে দিয়ে নগরবাসীর মধ্যে সুনাম কুড়িয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনার মাহাবুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সব পুলিশ সদস্যকে মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিই দেওয়া হয়েছে। তল্লাশি চালানোর সময় নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা হচ্ছে। প্যাট্রল ডিউটিতে যাওয়ার সময় দূরত্ব বজায় রেখে গাড়িতে বসে থাকছেন পুলিশ সদস্যরা। ব্যারাকগুলোতে যাতে গাদাগাদি করে থাকতে না হয়, সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ডিএমপি কমিশনার প্রতিটি থানার পুলিশ সদস্যদের ভাগ ভাগ করে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দিয়েছেন, যাতে একসঙ্গে অনেকের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি না হয়। এ ছাড়া প্রতিটি থানায় প্রবেশমুখে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। অহেতুক কাউকে থানায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। 

ঢাকাসহ সারা দেশের পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার জন্য রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পুলিশ হাসপাতালের প্রধান (ডিআইজি) হাসান উল হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য সব ধরনের সুবিধা রাখা হয়েছে এই হাসপাতালে। করোনা চিকিৎসার জন্য আলাদা একটি ওয়ার্ড করা হয়েছে।

মাঠপর্যায়ে একাধিক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এত কিছুর পরও থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও লাইনের ব্যারাকে তাঁদের গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। এতে যে কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তা সহজে সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। আবার তল্লাশিচৌকিতে লোকজনের কাছে গিয়ে তল্লাশি চালাতে হচ্ছে। অনেক সময় লোকজনও না বুঝে পুলিশের খুব কাছে চলে আসছে। তা ছাড়া পুলিশ ভ্যানে একসঙ্গে সাত-আটজনকে পাশাপাশি বসে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। 

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ ব্যারাকগুলোর পাশের ভবন ভাড়া নিয়ে সদস্যদের রাখা হচ্ছে, যাতে গাদাগাদি করে থাকতে না হয়।