লকডাউনে আশা, লকআউটে অন্ধকার

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

আমি যে তলায় ভাড়া থাকি, ঠিক তার ওপরের তলায়, ছাদের দিকে দুটি ফ্ল্যাটের একটাতে থাকেন সাইফুল সাহেব। ভদ্রলোক কথা বলার সময় কিছু শব্দের শেষে নিজের অজান্তেই লি...জুড়ে দেন...‘পরেলি ব্যাপারটা কী হলো জানেন’ এই টাইপ। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিকের মানুষ হলে বিষয়টাকে আঞ্চলিকতা বলা যেত, কিন্তু তিনি রাজবাড়ীর মানুষ! এই যে সাইফুল সাহেবের গ্রামের বাড়ি কোন জেলায়, তার পড়াশোনা কী বিষয়ে, এখন তিনি কোথায় চাকরি করছেন, সবই আমার মুখস্থ। শুধু কি তা–ই, উত্তরের শেষ জেলা পঞ্চগড়ের একটি মেয়ের সঙ্গে ভদ্রলোকের মোবাইল ফোনে পরিচয়, প্রেম এবং তারপর বিয়ে। একেবারে হাঁড়ির খবর বলতে যা বোঝায়।

সংবাদকর্মী হিসেবে মানুষের ভেতরের খবর বের করে আনার গুণ হয়তো কিছুটা আছে, কিন্তু আট বছর ধরে যে বাসায় ভাড়া থাকছি, সে বাড়িওয়ালা ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। আমি একজন অসামাজিক ব্যক্তি। এই বদনাম আমার আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে ঘরের বউয়ের কাছেও একই রকম।

মহামারি করোনা আমাকে সামাজিক করেছে। সপ্তাহে তিন দিন অফিস, কাজের চাপ কম, বিকেলের আগেই বাসায় ফিরে আসি। ফ্ল্যাটের অন্য প্রতিবেশী বাচ্চাদের ঘুড়ি উৎসব দেখতে ছেলেমেয়েকে নিয়ে ছাদে উঠি। সেখানেই পরিচয়...বায়িং হাউস পরিচালনায় দক্ষ আওলাদ ভাই, ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল ভাইদের সঙ্গে।

তবে সবচেয়ে বেশি গল্প হয় বয়সে ছোট দিনারের সঙ্গে। সেও ছাদের দিকের একটি ঘরে থাকে। আমাদের দুজনের স্ত্রীর আবার একই নাম! তাদের দুজনের মধ্যে গভীর একটা সম্পর্ক আমাদেরও কাছাকাছি করেছে।

দিনারের সঙ্গে গল্প জমে যাওয়ার আরও একটি কারণ আছে। সে চাকরি করত একটি পাঁচ তারকা হোটেলের হসপিটালিটি উইংয়ে। দেশের বড় বড় শিল্পপতি, বিদেশি এয়ারলাইনসের পাইলট-কেবিন ক্রু আর ফরেন বিজনেসম্যানদের মজার সব গল্প শুনে শুনে সময় বেশ ভালো কেটে যাচ্ছিল, করোনার দুশ্চিন্তা মাথা থেকে বাইরে রাখা যেত ঘণ্টা তিনেক।

জুনের শুরুর দিনই মজার গল্পে বিরাট ধাক্কা লেগেছে। করোনা মহামারিতে সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ প্রায় তিন মাস। অন্য দেশগুলোর মতোই হোটেল ব্যবসা লাটে। মাস তিনেক বেসিকের অর্ধেক বেতন কর্মীদের পরিশোধ করেছে হোটেল ম্যানেজমেন্ট। সেটা মেনেই ঘরে বসেছিল পাঁচ তারকার কর্মীরা। কিন্তু জুন শুরুর দুই দিন আগে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে সেই মানুষগুলোর। অন্তত ৪০০ কর্মীর হাতে তুলে দিয়েছে অব্যাহতিপত্র। চাকরি হারানোদের মধ্যে দিনারও আছে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে স্বপ্নবাজ তরুণ পড়েছে এখন অথই সাগরে।

ট্যাকনিক্যাল কাজ জানেন বলেই আশা দেখছেন। কিন্তু অস্থিরতা থেকে বের হতে পারছেন না। গ্রামের বাড়িতে চালের কল আছে, কৃষিজমি আছে, সেখান থেকে বছরে কিছু টাকা আসে। মাথার ওপর আছেন শিক্ষক মা। বিপদে মাসে মাসে মায়ের কাছ থেকেও সহযোগিতা মিলবে। কিন্তু দিন শেষে একটা চিন্তাই মাথার মধ্যে...বসে খেলে যে রাজার কোষাগারও খালি হয়।

করোনার এই সময়ে জুতসই নতুন চাকরি মেলানো কঠিন নয়, প্রায় অসম্ভব। রাজধানী ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেলে মাসের খরচ অর্ধেক কমে যাবে। কিন্তু তাতেও একটা সমস্যা দেখেন দিনার। গ্রামের মানুষের বাঁকা কথা বলার অভ্যাস। মানসিক শক্তি ভেঙে পড়তে পারে এই ভয়ে আপাতত শহর ছাড়তেও চাইছেন না। এখানে থেকেই কিছু একটা করা চাই।

নতুন চাকরি যখন অনিশ্চিত, তখন বিকল্প পথ ধরেছে তরুণ। ইউরোপ আর নর্থ আমেরিকান বিশ্ববিদ্যায়গুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে। হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার পাশাপাশি উন্নত জীবনের আশা দেখছেন। যদিও স্ত্রী-সন্তানকে দেশে রেখে একা বিদেশ পাড়ি দেওয়ার চ্যালেঞ্জটাও মাথার কোণে যন্ত্রণা হয়ে থেকে যাচ্ছে।

কাজের কারণে ইউরোপ, আমেরিকা যাওয়া হয়েছে তাই আমার কাছে পরামর্শ চায় দিনার। যতটুকু অভিজ্ঞতা আছে তার সবটুকুই শেয়ার করার চেষ্টা করছি, আশার কথা শোনাচ্ছি বিষণ্ন সন্ধ্যাগুলোতে। আগে কখনো বিদেশ যায়নি দিনার। এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও না। শেষ পর্যন্ত ইউরোপ কিংবা কানাডায় স্টুডেন্ট ভিসা হবে কি না, এই নিয়েও দুশ্চিন্তা আছেই। সবচেয়ে বড় ব্যাপার করোনায় পুরো পৃথিবী হয়ে আছে লকডাউন। সীমান্ত বন্ধ। কবে হবে স্বাভাবিক, তা–ও কেউ বলতে পারছে না।

দিনারের বিশ্বাস, দিন এভাবে যাবে না। দ্রুতই ঠিক হবে সবকিছু। তার চোখে সাহসের ঝলকানি দেখে আমার ভালো লাগে! নিজেও সাহস পাই। আশা-নিরাশার গল্পে ফের সন্ধ্যা নামে, ঘন হয়ে আসা অন্ধকারে দিনারের চোখ আর দেখতে পাই না! আঁধার কেটে কবে আসবে সোনালি ভোর?

* সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার, একাত্তর টিভি। খিলক্ষেত, ঢাকা। [email protected]