>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ থেকে অবসর নিয়েছি অনেক দিন হলো। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, নতুন করে আর কোনো কাজে যোগ দেব না, পরিবারের সঙ্গেই থাকব। এর মধ্যে মেয়ে সেঁজুতি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মলিকুলার বায়োলজিতে পিএইচডি করে দেশে ফিরে এল। বাংলাদেশে কাজ করবে, আমাদের সঙ্গে থাকবে। আমাদের মহা-আনন্দ।
কিছুদিন পরে মনে হলো, আমাদের ছেলে সুদীপ্তর সঙ্গে অনেক দিন দেখা নেই। সুদীপ্ত টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে অণুজীববিদ্যায় স্নাতক হয়ে হার্ভার্ডে মাস্টার্স করেছে। পিএইচডি করার ফাঁকে এক বছরের অবকাশ নিতে চলে এসেছে কানাডায়। সেখানে ফেডারেল সরকারের ফেলোশিপে যোগ দিয়েছে এক বছরের জন্য। ভাবলাম, ওর কাছে গিয়ে কিছুদিন থেকে আসি। যেই কথা সেই কাজ। চলে এলাম কানাডায়।
অনেক দিন পর মায়ের হাতে বাঙালি রান্নাবান্না পেয়ে সুদীপ্তও খুশি। এর মধ্যেই খবর এল, চীনের উহান শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটা রোগ দেখা দিয়েছে। আমি নিজে অণুজীববিজ্ঞানী। বিষয়টি ভালো করে জানার চেষ্টা করছি।
দেখতে দেখতে ভাইরাসটি নানা দেশ ঘুরে পৌঁছে গেল কানাডাতেও। সুদীপ্ত প্রায়ই অনেক রাতে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরে। কথা বলার সুযোগ হয় না। একদিন জানতে চাইলাম, কী নিয়ে সে এত ব্যস্ত। বলল, ও যুক্ত হয়েছে কানাডা সরকারের কোভিড-১৯ রেসপন্স টিমে সহযোগিতার কাজে। যতই ক্লান্ত হয়েই ফিরুক, দুর্যোগের সময় মানুষের সেবায় কাজ করছে, শুনে ভালো লাগল।
বিদেশে বসে দেশের খবর রাখার চেষ্টা করি। আরও বেশি টেস্ট করার কথা বলছেন সবাই। জানতে পারলাম, চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন ঢাকা শিশু হাসপাতালকে সঙ্গে নিয়ে সন্দেহভাজন কোভিড-১৯ রোগীদের পরীক্ষা করার ইচ্ছা জানিয়েছে। শুনে ভালো লাগল, সরকার তাদের পরীক্ষার সুযোগ দিয়েছে। ভয়ও লাগল, যে দলটি কাজ করবে, তারাও সংক্রমিত হবে না তো! আমার স্বামী সমীর সাহা সেখানে আছে। তাকে ফোন করে জানালাম আমার ভয়ের কথা। ও বলল, ‘দ্যাখো, মুক্তিযুদ্ধ করার সুযোগ আমরা পাইনি। এমন একটা সময়ে কাজ করতে পারলে তো দেশের জন্য কিছু করতে পারলাম বলে তৃপ্তি পাব। তা ছাড়া আমাদের ল্যাবরেটরিতে সব রকমের সতর্কতা মানা হবে।’ আমার আর কথা বলার আর কিছু থাকল না।
টিভিতে দেখি, পৃথিবীতে কী চলছে। বাংলাদেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা যায় না। অস্থির হয়ে উঠে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিই। আমার ফেরার ফ্লাইট ৮ এপ্রিল। আমি টিকিট এগিয়ে আনি ২৫ মার্চে। তা–ও পারলাম না। ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেল তার আগেই। আটকে গেলাম কানাডায়।
সেখানে থাকতে থাকতে দেখলাম, কানাডায় মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে না। সরবরাহ অত্যন্ত কম। অথচ যারা বাইরে চলাফেরা করছে, তাদের জন্য এটা অতি জরুরি। বিষয়টি নিয়ে সুদীপ্তের সঙ্গে কথা বললাম। ও উৎসাহের সঙ্গে বলল, ‘মা, তুমি মাস্ক বানালে মানুষের খুবই উপকার হবে।’ ব্যস, হয়ে গেল শুরু।
অণুজীববিজ্ঞানের বাইরে সেলাই আমার অসম্ভব প্রিয় কাজ। ছেলের সঙ্গে মিলে সময় নিয়ে অনলাইনে মাস্ক বানানোর উপকরণ অর্ডার করলাম। এরপর চলল বানানোর কাজ। বিতরণ শুরু করলাম প্রথমে আশপাশের সবার মধ্যে। তারপর বন্ধুবান্ধব আর তাদের বন্ধুবান্ধবকে।
সুদীপ্ত জানাল, হাসপাতালগুলোতে মাস্কের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। যোগাযোগ করা হলো কয়েকটা হাসপাতালের সঙ্গে। আরও বেশি সংখ্যায় মাস্ক তৈরি করে ডাকে করে পাঠাতে শুরু করলাম হাসপাতালগুলোর ঠিকানায়।
নিজেকে এ কাজে ব্যস্ত রাখলেও দেশের আর পরিবারের চিন্তায় মন অস্থির হয়ে রইল। কত দিন হয়ে গেল আমার বৃদ্ধ শাশুড়িকে ছেড়ে এখানে আছি। কাজ করতে করতে ভাবি, কবে দেশে যাব, পরিবারের কাছে ফিরব। দেশে যারা কোভিড–১৯–এর দুর্যোগে ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করছে, তাদের সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে আমার?