সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াবে করোনা পরীক্ষার ফি

করোনা পরীক্ষার মূল্য বা ফি নির্ধারণ মানুষকে সরকারি হাসপাতাল ও বুথ থেকে দূরে রাখবে। দরিদ্র মানুষ পরীক্ষার সুযোগ কম নেবে। এতে সংক্রমণ ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা করোনা পরীক্ষায় মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এমন মতই প্রকাশ করেছেন। তাঁরা এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানিয়েছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারির শুরু থেকে করোনা পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে আসছে। তারা বারবার পরীক্ষা বাড়ানোর কথা বলেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটিও করোনা পরীক্ষা বাড়ানোর কথা বলেছে। সেখানে পরীক্ষায় মূল্য নির্ধারণ মানুষকে পরীক্ষা করাতে নিরুৎসাহিত করবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মহামারি সারা বিশ্বে দারিদ্র্য পরিস্থিতি উসকে দিয়েছে। মানুষের উপার্জনের পথ বন্ধ হয়েছে, অনেকের জীবিকা হুমকির মুখে। বিশ্বমন্দার কথা শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। দেশের বহু মানুষ কর্মহীন। জীবন-জীবিকা কঠিন হয়ে যাওয়ায় বড় শহর থেকে মানুষ গ্রামে ফেরত যাচ্ছে। ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশের বহু পরিবার এখন তিন বেলা খেতে পায় না। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ৪৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে।

এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগ ‘কোভিড-১৯ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ইউজার ফি’ বিষয়ে পরিপত্র জারি করেছে। পরিপত্রে বলা হয়েছে, বুথে ও হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষার জন্য ২০০ টাকা করে দিতে হবে। আর বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ৫০০ টাকা দিতে হবে। গতকাল এই পরিপত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

>হাসপাতালে ও বুথে ফি ২০০ টাকা, বাড়িতে ৫০০ টাকা
বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ফি ৩৫০০ ও ৪৫০০ টাকা।
করোনাকালে প্রায় ৩ কোটি মানুষ নতুন দরিদ্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহামারি পরিস্থিতিতে ২০০ বা ৫০০ টাকা নিম্নমধ্যবিত্ত বা দরিদ্র মানুষের কাছে অনেক বেশি টাকা। করোনার উপসর্গ থাকলেও অনেকে এই টাকা খরচ করে পরীক্ষা করাবেন না। পরীক্ষা না করিয়ে, চিকিৎসা না নিয়ে এরা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াবেন।’

করোনা শনাক্তকরণ হয় আরটি-পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে। সরকার শুরু থেকে এই পরীক্ষা বিনা মূল্যে করে আসছে। বর্তমানে ঢাকা শহরে সরকারি ৫টি হাসপাতালে ও ৩০টি বুথে বিনা মূল্যে এই পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ হয়। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্যকর্মীরা ঢাকা শহরের বাড়িতে গিয়েও নমুনা সংগ্রহ করছেন। জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। এপ্রিল মাসে সরকার চারটি বড় বেসরকারি হাসপাতালকে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছিল। ফি নির্ধারণ করে সাড়ে তিন হাজার টাকা। সেই সুযোগ দরিদ্র মানুষের জন্য ছিল না। এখন ঢাকা শহরে ১৮টি, চট্টগ্রামে দুটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি ও বগুড়ার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নমুনা সংগ্রহ করে। এই ২২টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে নমুনা দিলে ফি সাড়ে তিন হাজার টাকা, আর এরা বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করলে সাড়ে চার হাজার টাকা ফি দিতে হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘হাসপাতালের ফি আদায়ের নিজস্ব রসিদ আছে। কিন্তু বুথ বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহকারীদের কোনো রসিদ নেই। রসিদ ছাপার কাজ শেষ হলেই খুব শিগগির ফি আদায় শুরু হয়ে যাবে।’

কেন মূল্য নির্ধারণ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিপত্রে বলা হয়েছে, করোনা পরীক্ষা বিনা মূল্যে হচ্ছে, তাই করোনার উপসর্গ না থাকলেও অধিকাংশ মানুষ এই পরীক্ষার সুযোগ নিচ্ছে। 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘সরকারের ধারণা উপসর্গহীন এসব মানুষ বিনা কারণে ভিড় জমাচ্ছে। একধরনের আতঙ্ক বা ভয়ের কারণে ভিড় করছে। কিন্তু এই ভিড় হচ্ছে সরকারের যোগাযোগ কৌশলের ব্যর্থতার কারণে। সরকার মানুষকে ঠিক সময়ে ঠিক তথ্য দিতে পারেনি।’

অন্যদিকে কত মানুষ উপসর্গ ছাড়াই পরীক্ষা করাচ্ছে তার কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নেই। অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, প্রায় ৭৫ শতাংশ পরীক্ষার ফল নেগেটিভ বা ঋণাত্মক আসছে। অর্থাৎ তাদের পরীক্ষা না করলেও চলত। তাঁদের কারণে যাঁদের দরকার তাঁরা পরীক্ষা করাতে পারছেন না।

পরীক্ষার ফি নির্ধারণের পেছনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আরও একটি যুক্তি দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, কারও বাড়িতে পরীক্ষার নমুনা আনতে গেলে একাধিক মানুষের নমুনা আনতে হয়। এদের অনেকেরই হয়তো প্রয়োজন নেই। এটি একটি সমস্যা। 

তবে জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘একজন বস্তির মানুষ চাপ দিয়ে বা অনুরোধ করে বাড়তি পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারেন না। এটা সম্ভব হয় সমাজের প্রভাবশালী মানুষের পক্ষে। দরিদ্র মানুষ পরীক্ষার সুযোগ না পেলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে।’

বিশেষজ্ঞরা আরও বলেছেন, আরটি-পিসিআর যন্ত্রে কত শতাংশ পরীক্ষার ফল সঠিক হচ্ছে তা সরকার এখনো প্রকাশ করেনি। সেটা প্রকাশ করলে প্রকৃত ঋণাত্মকের হার কম হবে। দ্বিতীয়ত, উপসর্গহীন পরীক্ষাপ্রার্থীর মধ্যে কত মানুষ ধনী, মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র, সেই তথ্যও তাদের কাছে নেই। বহু মানুষের সামর্থ্য আছে ২০০ টাকা খরচ করার। এদের একটি অংশকে বিরত রাখতে আরও সঠিক তথ্য-উপাত্ত দরকার। 

কারা বঞ্চিত হবে

সরকার বলছে, মুক্তিযোদ্ধা, দুস্থ ও দরিদ্র মানুষ বিনা মূল্যে করোনা পরীক্ষা করাতে পারবে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সমস্যা দেখা দেবে দরিদ্র মানুষকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে।

অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর বলেন, দেশে এখন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। এর প্রায় অর্ধেক নতুন দরিদ্র হয়েছে করোনার কারণে। গত এপ্রিলের একটি জাতীয় জরিপে তাঁরা এই তথ্য পেয়েছিলেন।

ওই জরিপ বলছে, দেশের ২৩ শতাংশের বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। আর আগে ছিল ২০ শতাংশ দরিদ্র। এখন মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৩ শতাংশ দরিদ্র। 

দরিদ্র্য মানুষ বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ বেশ কিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে আছে। তাঁদের সেই ধরনের পরিচয়পত্র আছে। পরীক্ষার কাজে তাঁরা তা ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু নতুন তিন কোটি দরিদ্র মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে না থাকায় পরীক্ষা করাতে তাদেরই পরিচয়ের সমস্যা হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এতে দেশে সেবার ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও বাড়বে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলেছে, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতের বৈষম্য মহামারি পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলতে পারে।

এ ব্যাপারে অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘নতুন ব্যবস্থায় সাময়িক কিছু সমস্যা হয়তো দেখা দেবে। কিছুদিন পরেই এসব ঠিক হয়ে যাবে।’

বিকল্প প্রস্তাব

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগ প্রতিরোধ করার দায়িত্ব সরকারের। প্রতিরোধ সেবা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিনা মূল্যেই হয়। করোনা পরীক্ষা প্রতিরোধ কর্মকাণ্ডেরই অংশ। এ ক্ষেত্রে সরকারের অর্থের অভাব নেই। বিশ্ব ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা দিয়েছে করোনা মোকাবিলায় খরচ করার জন্য। এ ছাড়া সরকার ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দিয়েছে এই খাতে। পরীক্ষায় খরচ বাড়ালে করোনা চিকিৎসায় খরচ কম হবে।

নমুনা সংগ্রহের স্থানগুলোতে জ্বর, কাশি বা করোনার অন্য উপসর্গ দ্রুত পরীক্ষার একটি আয়োজনও করা যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সেই ব্যবস্থা থেকে কিছু মানুষকে বাদ দিলে নমুনা পরীক্ষার চাপ কমবে।

অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘অতীতে সরকারি হাসপাতালে ফি চালু করে সরকার সুফল পায়নি। এই মহাদুর্যোগের সময় রাষ্ট্রকে তার নাগরিকের পাশে দাঁড়াতে হবে, প্রান্তিক মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের উচিত পরীক্ষার ফি নেওয়ার সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহার করা।’