করোনার পরীক্ষা যখন বাড়ানো প্রয়োজন, তখনই 'নিয়ন্ত্রিত'

ছবি রয়টার্স
ছবি রয়টার্স

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের পরীক্ষা যখন আরও বাড়ানো প্রয়োজন, তখনই তা ‘নিয়ন্ত্রিত’ হয়ে পড়ছে। জ্বর, কাশি, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট—এই চারটি উপসর্গ না থাকলে করোনা শনাক্তের পরীক্ষার জন্য কারও নমুনা নেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে বিভাগীয় স্বাস্থ্য কার্যালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জনদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে পরীক্ষা নিরুৎসাহিত করতে সরকারি ফি আরোপ এবং কিটের স্বল্পতার কারণে কম নমুনা সংগ্রহের বিষয়টি তো রয়েছেই।

জুন মাসের শেষের দিকে ১৭ হাজার থেকে ১৮ হাজার নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু গত চার দিন (৩ থেকে ৬ জুলাই) ধরে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে ১৩ থেকে সাড়ে ১৪ হাজার। এর আগের চার দিনের (২৯ জুন থেকে ২ জুলাই) তুলনায় পরের চার দিনে ১৪ হাজার ৮৯০টি পরীক্ষা কম হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে সরকার দেশে করোনার সংক্রমণ কম দেখালে সমস্যার সমাধান হবে না; বরং সংক্রমণ পরিস্থিতি লুকানোর চেষ্টা সবার জন্যই বিপদ ডেকে আনবে।

করোনা মোকাবিলায় সরকার গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দৈনিক অন্তত ২০ হাজার পরীক্ষা হলেও সংক্রমণের ধরন বোঝা যেত। পরীক্ষা বাড়ার বদলে কমে গেল কেন, সেটির কোনো ব্যাখ্যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিচ্ছে না। গত মে মাসের শেষ দিক থেকে পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার বেশি দেখা যাচ্ছে। এই সময়ে আরও বেশি করে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা দরকার।

গত মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই পরীক্ষা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সংক্রমণ মোকাবিলায় বারবার পরীক্ষা বাড়ানোর কথা বলে আসছে।

দুজন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক এবং তিনজন সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রিত করার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। রোগী শনাক্ত বাবদ ব্যয় কমানো, পরীক্ষার কিটের স্বল্পতা, সরকারি পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোর ওপর চাপ কমানো, অপরীক্ষিত নমুনার জট না রাখা, অপ্রয়োজনে উপসর্গহীন ব্যক্তির পরীক্ষা বন্ধ করা অন্যতম।

নাম না প্রকাশের শর্তে একজন বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এখন পাঁচজনের পরীক্ষা করলে একজনের করোনা শনাক্ত হচ্ছে। প্রতিজনের পরীক্ষা করতে সরকারের খরচ পড়ে সব মিলিয়ে ৩ হাজার টাকার মতো। অর্থাৎ, ১৫ হাজার টাকা খরচ করে একজন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। সরকার এই ব্যয় কমাতে মোটামুটি নিশ্চিত রোগীদের পরীক্ষা করাচ্ছে।

তবে উপসর্গ ছাড়া পরীক্ষা না করানোর সিদ্ধান্তের পরও রোগী শনাক্তের হারে খুব বেশি হেরফের হচ্ছে না। গত ২৬ জুন ১৮ হাজার ৪৯৮ জনের নমুনা পরীক্ষা হয়। সেদিন রোগী শনাক্তের হার ছিল ২০ দশমিক ৯১ শতাংশ। আর ৫ জুলাই নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৩ হাজার ৯৮৮টি। রোগী শনাক্তের হার ছিল ১৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্রের দায়িত্বে থাকা হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক আয়শা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষা কম হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। সুস্থ রোগীদের দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার পরীক্ষা করা হচ্ছে না। বন্যার কারণে কিছু জেলার নমুনা পেতে সমস্যা হচ্ছে। ফি চালু করায় অনেকে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষাও করাচ্ছে না। উপসর্গ রয়েছে এমন পজিটিভ রোগীদের আগে চিহ্নিত করছে সরকার। নমুনা সংগ্রহের পুরো ব্যবস্থাটি অনলাইনে নেওয়ার কাজ চলছে, তাই ব্র্যাকের বুথগুলোতে নমুনা নেওয়া কমানো হয়েছে।

দেশে করোনা পরীক্ষা কম হওয়া নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনা হচ্ছে। পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্য অনুযায়ী, জনসংখ্যার অনুপাতে পরীক্ষার দিক থেকে বিশ্বের ২১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৪৬তম। আর লক্ষাধিক কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী রয়েছে, এমন দেশগুলোর মধ্যে মেক্সিকোর পরে সবচেয়ে কম পরীক্ষা হচ্ছে বাংলাদেশে।

বুথে নমুনা সংগ্রহ কমানো হয়েছে

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও গাজীপুরে বুথের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করে। প্রতিটি বুথ থেকে দৈনিক ৩০টি করে নমুনা সংগ্রহ করা হতো। রাজধানীর তিনটি নমুনা সংগ্রহের বুথে কথা বলে জানা যায়, গত ২০ দিন ধরে প্রতিটি বুথ থেকে দৈনিক ১৫টি করে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই ১৫টির মধ্যে ১০টি অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে আর ৫টি বুথ থেকে সরাসরি সংগ্রহ করা হচ্ছে।

>জনসংখ্যার অনুপাতে করোনা পরীক্ষার দিক থেকে বিশ্বের ২১৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৪৬তম
দেশের ৪২টি জেলায় এখনো করোনা শনাক্তের পরীক্ষাকেন্দ্র নেই

ফি নির্ধারণে কমেছে নমুনা পরীক্ষা

গত ২৯ জুন থেকে সরকারিভাবে করোনা পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করেছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। বুথে গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করানোর জন্য ২০০ টাকা লাগছে, আর বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করানোর জন্য দিতে হচ্ছে ৫০০ টাকা। এর আগে গত মার্চ থেকে সরকারিভাবে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা বিনা মূল্যে হয়েছে।

দিনাজপুরের সিভিল সার্জন আব্দুল কুদ্দুস প্রথম আলোকে বলেন, নমুনা পরীক্ষার জন্য ফি নির্ধারণ করার পর থেকে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

পরীক্ষা ছাড়াই ছাড় পাচ্ছেন রোগী

কোনো ব্যক্তির করোনা পজিটিভ হলে চিকিৎসা নেওয়ার পর দুটি পরীক্ষায় নেগেটিভ ফল এলে তিনি করোনামুক্ত বলে চিকিৎসকের ছাড়পত্র পেতেন। সরকারি হাসপাতালে এখন সেটিও করা হচ্ছে না। করোনা পজিটিভ ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার পরীক্ষা না করলে অনেক কিট সাশ্রয় হবে—এই উদ্দেশ্য থেকেই মূলত এমন সিদ্ধান্ত বলে একজন সিভিল সার্জন জানান।

করোনার জন্য নির্ধারিত দুটি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, রোগী সুস্থ হয়ে গেলে, পরপর তিন দিন যদি তাঁর কোনো উপসর্গ না থাকে, তাহলে তাঁকে সুস্থ বিবেচনা করে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁরা পরীক্ষা করে করোনা নেগেটিভ নিশ্চিত হয়ে রোগী ছাড়ছেন।

নতুন কোনো জেলায় পরীক্ষা শুরু হয়নি

গত ১৮ জুন নিয়মিত বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, যত দ্রুত সম্ভব সরকারি ব্যবস্থাপনায় জেলা পর্যায়ে আরটিপিসিআর পরীক্ষা শুরু হবে। এরপর ২০ দিন পার হলেও সরকারিভাবে নতুন কোনো জেলায় করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র চালু হয়নি। এখনো দেশের ৪২টি জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র নেই।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, করোনা পরীক্ষার জন্য জেলায় একটি পরীক্ষাকেন্দ্র চালু করতে মাস দেড়েক আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। কবে নাগাদ চালু করা হবে, সে বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।

অ্যান্টিজেন পরীক্ষা দ্রুত চালুর তাগিদ

গত ৩ জুন সরকার গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটি দ্রুত করোনার অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চালু করতে বলেছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় পজিটিভ এলে আরটিপিসিআর পরীক্ষাতেও পজিটিভ আসার সম্ভাবনা শতভাগ। যে কেউ সহজে, যেকোনো জায়গায়, কম খরচে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করাতে পারেন। এটি পরীক্ষা করা যায় ২০ মিনিটে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষার আওতা আরও বিস্তৃত করে তা কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। এ জন্য পিসিআর পদ্ধতির পাশাপাশি দ্রুত র‌্যাপিড কিটের মাধ্যমে করোনার অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চালু করা দরকার। তিনি বলেন, এই সময়ে পরীক্ষা বাড়ানো দরকার। একটি বা দুটি উপসর্গ থাকলে, এমনকি কারও ক্ষেত্রে উপসর্গ না থাকলেও করোনা পরীক্ষা করতে হবে।