সব হারিয়ে দিশেহারা তাঁরা

বানের পানিতে কষ্টে আছেন চরের মানুষ। ঘরদুয়ার ডুবে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তাঁরা। সম্প্রতি বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কুঁড়িপাড়া চরে।  ছবি: প্রথম আলো
বানের পানিতে কষ্টে আছেন চরের মানুষ। ঘরদুয়ার ডুবে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তাঁরা। সম্প্রতি বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কুঁড়িপাড়া চরে। ছবি: প্রথম আলো

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের যমুনা নদীর দুর্গম চর উত্তর শিমুলতাউড়। এক মাস আগেও এই চরে বসবাস ছিল দুই শতাধিক পরিবারের। চরের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় নির্মাণ করা হয়েছে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক। আট শতক জায়গার ওপর ২৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত কমিউনিটি ক্লিনিকটি এখনো চালু হয়নি। কমিউনিটি ক্লিনিকের ভবনটি এখন যমুনা নদীর ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে। এরই মধ্যে যমুনার প্রবল ভাঙনের কারণে উত্তর শিমুলতাইড় চরের প্রায় ২০০ পরিবার বসতবাড়ি হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।

শিমুলতাইড় চরের সচ্ছল কৃষক ছিলেন ইউসুফ আলী শেখ (৫৫)। এক মাস আগেও ৪০ বিঘা আবাদি জমি ছিল তাঁর। এক মাসের ব্যবধানে তিনি এখন নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত। যমুনার প্রবল ভাঙনে বিলীন তাঁর পৈতৃক ভিটেমাটি, জায়গাজমি। সব হারিয়ে দিশেহারা ইউসুফ আলী শেখ স্ত্রী–সন্তান নিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন দুর্গম চরের একটি গুচ্ছগ্রামের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে।

নদীভাঙনে বসতভিটা, সরকারি স্থাপনা, লোকালয় ও গাছপালা বিলীনের এই চিত্র বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীর বেশ কয়েকটি চরের। সবচেয়ে বেশি নদী ভাঙছে শিকার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের উত্তর শিমুলতাউড়, আউচারপাড়া, সুজালীপাড়া, বিরামের পাঁচগাছি, ফাজিলপুর, কাশিরপাড়া ও মানিকদাইড় চরে। গত এক মাসে এসব চরের প্রায় ৯০০ বসতবাড়ি, ১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নদীতে বিলীন হয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে আউচারপাড়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়। এ ছাড়া নদীতে বিলীন হয়েছে বহুলাডাঙ্গা চর এবং পাকুরিয়া চরের দুটি কমিউনিটি ক্লিনিকের ভবন।

চালুয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (ইউপি) শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, যমুনায় পানি যত কমছে, ভাঙনের আতঙ্ক তত বাড়ছে।

 গতকাল বুধবার চরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক মাসে নদীভাঙনে শিমুলতাইড় চরে ২০০টি, সুজালীপাড়া চরে ১৫০, আউচারপাড়া চরে ৩০০, বিরামের পাঁচগাছি চরে ১২০, ফাজিলপুর চরে ৩০, মানিকদাইড় চরে ৫০ ও কাশিরপাড়া চরে অন্তত ৫০টি বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে। যমুনায় বসতভিটা, জায়গাজমি হারিয়ে দিশেহারা আশ্রয়হীন অনেক পরিবার সুজালীপাড়া গুচ্ছগ্রামে এবং পাশের সোনাতলা উপজেলার তেকানীচুকাইনগর চরের উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। এসব পরিবারের লোকজন অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

>যমুনায় কমছে পানি, ভাঙছে লোকালয়। এরই মধ্যে উত্তর শিমুলতাইড় চরের প্রায় ২০০ পরিবার বসতবাড়ি হারিয়েছে।

 আউচারপাড়া, উত্তর শিমুলতাইড়, সুজালীপাড়া ও বিরামের পাঁচগাছি চরের লোকজন জানান, মাসখানেক আগেই নদীভাঙন শুরু হয়। উত্তর শিমুলতাইড় চরের আবদুল ওয়াহেদ (৬৯) প্রথম আলোকে বলেন, গত ৪০ বছরে ২৮ দফা বসতবাড়ি ভেঙেছে তাঁদের। ১৩ বছর কেটেছে কাকালিহাতা চরে। সর্বশেষ ১৯৮৮ সালের বন্যার পর থেকে শিমুলতাইড় চরে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, ‘হপ্তা (সপ্তাহ) তিনেক আগে বিয়ানবেলা নদী গর্জে উঠল। দুই কালের (যুগ) বসতভিটা নিমিষেই শ্যাষ।’

সুজালীপাড়া গুচ্ছগ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে উঁচু জায়গায় ঠাঁই হয়েছে বসতভিটা হারানো বানভাসি প্রায় ৪০০ পরিবারের। পৈতৃক ভিটা থেকে কোনো রকমে টিনের বেড়ার দোচালা ঘর, সহায়–সম্বল, ঘটিবাটি নৌকায় তুলে আশ্রয় নিয়েছেন এই শিবিরে।

উত্তর শিমুলতাইড় চরের দিনমজুর শাহিন মিয়া দুই সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। সঙ্গে স্ত্রী সমীরণ বিবি। শাহিন মিয়া বলেন, ‘বসতভিটা নদীর প্যাটত। ১৬ দিন আগত এটি অ্যাসে ঠাঁই লিচি। বউ-ছল লিয়ে খুব কষ্টত আচি।’

শিমুলতাউড় চরের রহিম শেখ বলেন, ‘বসতবাড়ি, জায়গাজমি সব যমুনাত শ্যাষ। কোন কূলকিনারা না পেয়ে এটি খোলা জায়গাত রাত কাটাচ্চি। পানি নামে গেলেও কী করমো, কী খামো সেই চিন্তা করিচ্চি।’

যমুনার প্রবল ভাঙনে বিলীন আউচারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বহুলাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিক। নদীভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে আউচারপাড়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভবনও। আর ২০০ গজ নদী ভাঙলেই বিলীন হবে বিদ্যালয়টি। অন্যদিকে ২০০৭ সালে ছয় শতক জায়গায় নির্মিত হয়েছিল বহুলাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিকের পাকা ভবন। মাসখানেক আগে যমুনার ভাঙনে বিলীন এই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রও। এদিকে বুধবার যমুনার গর্ভে বিলীন হয়েছে পাকুরিয়া চরের কমিউনিটি ক্লিনিকটিও। আর কার্যক্রম চালু না হতেই ভাঙনের মুখে পড়েছে সদ্য নির্মিত উত্তর শিমুলতাইড় চরের কমিউনিটি ক্লিনিক।

সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাসেল মিয়া বলেন, এক মাস ধরে যমুনার ভাঙনে দুটি কমিউনিটি ক্লিনিক ও একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীতে বিলীন হয়েছে। বসতবাড়ি ও আবাদি জমিও ভেঙেছে। এখন আরও একটি সদ্য নির্মিত কমিউনিটি ক্লিনিক ও একটি বিদ্যালয় ভাঙনের মুখে পড়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের আসবাব অন্যত্র সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে।