করোনামুক্তদেরও দায় আছে

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

করোনাভাইরাস মহামারি বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী যেভাবে মানুষের জীবনযাত্রা বদলে দিয়েছে, তার প্রভাব আমার জীবনেও পড়েছে। মার্চের ১৮ তারিখ থেকে গৃহবন্দী অবস্থায় এর নানামুখী প্রভাব অনুভব করলাম, যা ছিল উৎকণ্ঠা, আনন্দ ও লড়াইয়ের।

দেশে ভাইরাসটির ক্রমবর্ধমান বিস্তারে অন্য সবার মতো আমিও চরমভাবে উৎকণ্ঠিত। আমাদের দ্বিতীয় ছেলে মাহফুজ মজুমদার নিউইয়র্কের ব্রুকলিন শহরের একটি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত। মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত নিউইউয়র্কে তার সামনেই অনেকের মৃত্যু হয়েছে। এর বেদনা সে বহন করছে। আমরা উৎকণ্ঠিত তার এবং তার পরিবারের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে।

আমাদের প্রথম সন্তান মাহবুব ও পুত্রবধূ শারমিনের একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হলো ২০ মার্চ, নিউইয়র্কে। চরম উৎকণ্ঠার মধ্যেও এটি ছিল সুসংবাদ।

মার্চ মাসে সহকর্মীদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমরা স্থানীয় পর্যায়ে করোনাভাইরাসকে প্রতিহত করার উদ্যোগ নেব। এ ল‌ক্ষ্যে আমাদের প্রশি‌ক্ষিত স্বেচ্ছাব্রতীরা নিজ নিজ গ্রামে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। লক্ষ্য ছিল, করোনাভাইরাস থেকে প্রান্তিক মানুষসহ প্রত্যেকের সুরক্ষাই সেসব গ্রামবাসীর সুরক্ষা নিশ্চিত করবে, এমন দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি করা।

চরম সতর্কতা সত্ত্বেও মে মাসের শেষ দিকে আমার স্ত্রী, দুই কন্যা ও আমি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়লাম। মাহফুজের চিকিৎসায় অন্যরা দ্রুত সেরে উঠলেও বার্ধক্য ও হৃদ্‌রোগের কারণে ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমার লড়াই চলে মাসখানেক। সংক্রমিত অবস্থায়ও নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখতে এবং আমার সহকর্মীদের উৎসাহিত করতে চেষ্টা করেছি। চাপমুক্ত থাকার জন্য জীবনের মধুর স্মৃতিগুলো রোমন্থন করেছি।

স্মরণ করেছি অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আমার টিকে থাকার ঘটনাগুলো। মায়ের কোলে থাকাকালে আমি কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলাম। ১৯৮৩ সালে আমেরিকার ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে এক সড়ক দুর্ঘটনায় এমন গুরুতর আহত হই যে আমাকে হেলিকপ্টারে করে হাসপাতালে নিতে হয়। সে দফায়ও আমি বেঁচে যাই। তাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মনে হয়েছে, আমার মনোবল ও শারীরিক সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এই রোগও প্রতিহত করতে পারব।

শয্যাশায়ী অবস্থায় মনে পড়ল আয়রন উইল সিনেমাটির কথা। তাতে ১৭ বছর বয়সী উইল স্টোনম্যান চরম প্রতিকূলতা কাটিয়ে ৫২২ মাইলের ‘ডগ-স্লেজ’ দৌড় প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছিল। জয়ী হতেই হবে, এ প্রত্যয়ের কারণেই সে জয়ী হয়। মনে পড়েছে, বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে অপেক্ষমাণ পারস্য সম্রাট দারিউসের মুখোমুখি হয়ে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সেই কথিত বিখ্যাত উক্তি, ‘অনেক প্রচেষ্টার পর শত্রুকে সামনে পেয়েছি, তাই জয় আমাদের হয়েই গিয়েছে। বাকি তো শুধু যুদ্ধটা।’ আলেকজান্ডার যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। তাই নিশ্চিত ছিলাম, সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে আমিও করোনামুক্ত হব। এটি সময়ের ব্যাপারমাত্র।

এ ছাড়া মনে হয়েছে, আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। কবি রবার্ট ফ্রস্ট যা লিখেছিলেন, সেটিই ছিল মূলমন্ত্র, ‘অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ।’ ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ত্যাগ করে মাতৃঋণ শোধ করতে দেশে ফিরে আমাদের প্রতিষ্ঠান এবং পরে সুজনের মাধ্যমে সমাজের সব স্তরের মানুষের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে সংগঠিত করতে কাজ করেছি। এসব কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য বেঁচে থাকা দরকার।

আমি মনে করি, আমার মতো করোনামুক্ত মানুষদের দায়দায়িত্ব রয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য আমরাসহায়ক হতে পারি। এমন কোনো প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলে আমি খুবই উৎসুক। আগ্রহীদের যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ রইল।