মহামারিতে নারী-কিশোরীর সুরক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু।

কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বাল্যবিবাহ ও নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বেড়েই চলেছে। যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণসহ নারী ও কিশোরী স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় নারী ও কিশোরীদের অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

আজ শনিবার ‘কোভিড-১৯: নারী ও কিশোরী স্বাস্থ্য অধিকার সুরক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেওয়া সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ, নারী সংগঠক, শিক্ষক ও তরুণেরা এ মত প্রকাশ করেন।

বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো ও পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (পিএসটিসি)। এতে সহযোগিতা করে ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাস ও ইউনাইট ফর বডি রাইটস (ইউবিআর) অ্যালায়েন্স।

বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু বলেন, কোভিডের কারণে আজ আর্থসামাজিক স্বাভাবিক জীবনযাপন বিপর্যস্ত। ঘরবন্দী সময় ও আর্থিক সংকট থেকে মানসিক সংকটও তৈরি হয়েছে। এ থেকে নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করতে পুরুষদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তিনি জানান, এই সময়ে সীমিত যোগাযোগব্যবস্থার মধ্যেও দুর্গম এলাকায় তাঁর দপ্তরের স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে মা, শিশু ও কিশোরীদের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।

নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের (এসআরএইচআর অ্যান্ড জেন্ডার) জ্যেষ্ঠ পরামর্শক মাশফিকা জামান সাটিয়ার বলেন, মহামারি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য ইস্যুর বাইরে আরও কিছু সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক পরিবারের পুরুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। আর্থিক-মানসিক টানাপোড়েন থেকে পরিবারের নারী ও কিশোরীদের ওপর সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। সংকট মোকাবিলায় করণীয় ঠিক করতে সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ের ব্যক্তিদের আলোচনায় বসতে হবে।

নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের (এসআরএইচআর অ্যান্ড জেন্ডার) জ্যেষ্ঠ পরামর্শক মাশফিকা জামান সাটিয়ার।
নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের (এসআরএইচআর অ্যান্ড জেন্ডার) জ্যেষ্ঠ পরামর্শক মাশফিকা জামান সাটিয়ার।

ঢাকায় জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রতিনিধি অসা টরকেলসন বলেন, এই মহামারিতে বিশ্বজুড়ে যে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা শুরু হয়েছে, বাংলাদেশে এ হার উচ্চ। এ দেশে বাল্যবিবাহের মতো ক্ষতিকর চর্চা শুরু হয়েছে। অনেক মেয়ে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে। বিশ্বজুড়ে বদলের প্রক্রিয়ায় এক নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ শুরু হয়েছে। এই সময়ে নারী ও কিশোরীদের সুরক্ষা ও প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। মাতৃমৃত্যু হার, পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অপূর্ণ চাহিদা, জেন্ডারভিত্তিক নির্যাতনকে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে।

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুমের সূচনা বক্তব্যের পর বৈঠকে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন পিএসটিসির নির্বাহী পরিচালক নূর মোহাম্মদ।

সূচনা বক্তব্যে আব্দুল কাইয়ুম বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বাড়িতে নারীর ওপর বাড়তি কাজের চাপ, বাল্যবিবাহ ও নারীর প্রতি সহিংসতা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে । নারী ও কিশোরীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে তা সমাজে ও অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে পিএসটিসির নূর মোহাম্মদ বলেন, মহামারিতে অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ ও অনিরাপদ গর্ভপাত বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্য সেবাদানকারীরা কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় নারী ও কিশোরীরা প্রজননস্বাস্থ্য ও জেন্ডার সহিংসতার বিরুদ্ধে কোনো সেবা পাচ্ছেন না । তিনি ইউএনএফপিএর এক বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে জানান, আরও ছয় মাস মহামারি পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ৪ কোটি ৭০ লাখ নারী আধুনিক জন্মনিরোধক সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। তিন কোটি শিশু জন্ম নিতে পারে।

পিএসটিসির নির্বাহী পরিচালক নূর মোহাম্মদ।
পিএসটিসির নির্বাহী পরিচালক নূর মোহাম্মদ।

বৈঠকে অংশ নেওয়া পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু) মোহাম্মদ শরিফ বলেন, মাঠপর্যায়ের অনেক কর্মী কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলেও মা ও শিশুদের সেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি কিশোর-কিশোরীদের সুরক্ষায় ২৮৫টি উপজেলায় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে ভার্চুয়াল প্রচার চালানো হচ্ছে ।

ইউএসএআইডির স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ রিয়াদ মাহমুদ বলেন, সংক্রমণের এই সময়ে উন্নয়ন সহযোগীরা সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। সংক্রমণ পরীক্ষা, সার্ভিল্যান্স করা, সংক্রমণ প্রতিরোধ ও সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, সুরক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতির ভিত্তিতে তা সরবরাহ অব্যাহত রাখতে সহায়তা করছে।

পপুলেশন কাউন্সিলের এ দেশীয় প্রতিনিধি ওবায়দুর রব মাঠপর্যায় থেকে সঠিক তথ্য গ্রহণ ও তা ছড়ানোর ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, পরিবার ও সমাজের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন না করলে শুধু সরকারি কর্মকর্তা দিয়ে বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির বলেন, কোভিড-১৯ চলমান পদ্ধতির অনেক ভুল ধরিয়ে দিয়েছে। সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও সেবা দেওয়ার জন্য চলমান পদ্ধতির বিকেন্দ্রীকরণ দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য সরবরাহ গতিশীল রাখতে হবে। এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া সহজ হয়।

ঢাকায় জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রতিনিধি অসা টরকেলসন।
ঢাকায় জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রতিনিধি অসা টরকেলসন।

পিএসটিসির (জেন্ডার ও সুশাসন) কমপোনেন্ট ব্যবস্থাপক কানিজ গোফরানী কোরায়শী বলেন, কিশোরী ও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সামাজিক-মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করাও জরুরি।

পিএসটিসির নবীন কর্মী নীলিমা নাসরিন বলেন, জ্যেষ্ঠদের সঙ্গে নবীনদেরও কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। নবীনদের ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ দিতে হবে।

ইউবিআর পিএসইউয়ের টিম লিডার অনিতা শরীফ চৌধুরী বলেন, মহামারির সময়ে বাল্যবিবাহ ও জেন্ডার সহিংসতা রোধে এলাকার লোকজনদের নিয়ে সামাজিক অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

গাজীপুর থেকে অংশ নেওয়া যুব প্রতিনিধি জাহিদুল ইসলাম বলেন, নারী ও কিশোরীদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়ে পুরুষদের অবহিত করার মাধ্যমে সচেতন করে তুলতে হবে।

চট্টগ্রাম থেকে অংশ নেওয়া যুব প্রতিনিধি সামিয়া আফরিন বলেন, নিজ নিজ এলাকার তরুণদের সম্পৃক্ত করে বাল্যবিবাহ ও নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব।

বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।