কোভিড বানাল নারী উদ্যোক্তা

আমি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। সবার মতোই স্বপ্ন দেখতাম, লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করব। করোনাভাইরাসের কারণে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে এসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেল। টুকটাক প্রাইভেট টিউশনগুলোও চলে গেল হাত থেকে। পরীক্ষাই শেষ হলো না, চাকরি পাব কী করে—এই চিন্তায় ভেঙে পড়েছিলাম। ক্যারিয়ারের পথ হারিয়ে যাচ্ছে দেখে মরে যাওয়ার ইচ্ছা করত প্রতি রাতে। আমার সব থেমে গেল, আর কিছুই হবে না—এমন হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলাম গভীরভাবে।

মরিয়া হয়ে ভাবলাম, কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু ঘরে বসে কী করব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স (উই) ফোরামের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। সেখানে ফোরামের উপদেষ্টা রাজীব আহমেদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তিনি আমাকে একটা মজার পরামর্শ দিলেন। বললেন, ‘আপনি প্রতিদিন উইতে সময় দিন আর পড়াশোনা করুন। ই-কমার্স নিয়ে পড়ুন।’ ভাবলাম, আচ্ছা, ই-কমার্সটা পড়েই দেখি। পড়তে শুরু করলাম। ওখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্য নিয়ে প্রতিদিন নানা জানা-অজানা তথ্যও পেলাম। মনে মনে ঠিক করলাম, তাহলে দেশি পণ্য নিয়ে ই-কমার্সের উদ্যোগ নিয়েই দেখি না কেন!

দেশি পণ্যের সম্ভাবনা, সুযোগ ও ঝুঁকি কী হতে পারে ই-কমার্সে, সেসব বিষয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম। মন থেকে উধাও হয়ে গেল, পৃথিবী এখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। ইন্টারনেটের ওপর ভর করে কাজ শুরু করলাম রংপুরের ঐতিহ্যবাহী পণ্য শতরঞ্জি নিয়ে। দেখতে পেলাম, কোভিড-১৯-এর কারণে শতরঞ্জির কারখানাগুলো বন্ধ। সেসব কারখানার কারিগরদের বেঁচে থাকার লড়াই আমার মনে দারুণ আঘাত করল। ঠিক করলাম, কিছু একটা করতেই হবে। কাজ দিতে পারলে এই আর্থিক পরিস্থিতিতে গরিব মানুষগুলো একটু স্বস্তি তো পাবেন।

কারিগরদের বাড়িতে শতরঞ্জি তৈরির যন্ত্র আর সুতা কিনে দিয়ে এলাম আমার টিউশনির জমানো টাকা দিয়ে। তাঁরা বাড়িতে বসে শতরঞ্জি বানাতে শুরু করলেন। আমার বড় চ্যালেঞ্জ ছিল শতরঞ্জিগুলো বিক্রি করা। আমি নিয়মিত লিখতে শুরু করলাম আমাদের ফোরামের ফেসবুক গ্রুপে। সেখান থেকে একটা-দুটো করে অর্ডার আসতে শুরু করল। এখন মাসে আমার ২০ হাজার টাকার ওপরে রোজগার হচ্ছে ই-কমার্সটা বুঝে কাজে লাগানোর কারণে। দেখলাম, আমি বেশ একজন নারী উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছি।

কোভিড-১৯ আমাদের ভালো করে বুঝিয়ে দিচ্ছে, ইন্টারনেট ছাড়া আমরা আসলেই অচল। সহজেই হতাশাগ্রস্ত না হতে চাইলে ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়ে নিজের অবস্থার পরিবর্তন আনা সম্ভব। ই-কমার্স মেয়েদের জন্য সহজ ও নিরাপদ বটে। এখন আমি জোর গলায় বলতে পারি, ঠিকভাবে পড়াশোনা করে ইন্টারনেটকে কাজে লাগাতে পারলে কর্মসংস্থানের সমস্যা হওয়ার কারণ নেই। এখন আমি শুধু নিজের পরিবারকেই আর্থিকভাবে সাহায্য করছি না, আমার সঙ্গে কাজ করে রোজগার হচ্ছে আরও ১০টা পরিবারের।

করোনাভাইরাস না এলে আমি নিজেও জানতাম না আমার ভেতরে একজন উদ্যোক্তা লুকিয়ে আছে। আমরা চাইলেই যেকোনো পরিস্থিতিকে নিজেদের চেষ্টা ও পরিশ্রমে সুন্দর করে তুলতে পারি। করোনা আমাকে হতাশার এই সময়ে এমন একটা গভীর উপলব্ধি দিয়ে গেল।