ঢাকায় এ জি স্টকের অন্য রকম ঈদ

মেমোরিস অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি ১৯৪৭-১৯৫১   এ জি স্টক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি ১৯৪৭-১৯৫১   এ জি স্টক,  অনুবাদ: মোবাশ্বেরা খানম
মেমোরিস অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি ১৯৪৭-১৯৫১ এ জি স্টক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি ১৯৪৭-১৯৫১ এ জি স্টক, অনুবাদ: মোবাশ্বেরা খানম

শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের কিংবদন্তি শিক্ষক এ জি স্টক। 

এই ভিনদেশি শিক্ষক তাঁর দুই দফা অধ্যাপনার (১৯৪৭-৫১ এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর) অল্প কটি বছরে বিশ্ববিদ্যালয়সূত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্ত ছাপিয়ে বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিশে গেছেন নিবিড় নৈকট্যে।

বইয়ে আছে মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, খান সারওয়ার মুরশিদ ও তাঁর New values নামের তেজি পত্রিকার কথা। কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে ঢাকার কাছের গ্রামাঞ্চলে লোকগানের আসরে যোগ দেওয়ার অন্তরঘন স্মৃতি। আছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ধ্বস্ত এক জনপদ আবার ভাষা আন্দোলনের রক্তমহান মোহনায় সেই জনপদেরই জেগে ওঠার বিশ্বস্ত ভাষ্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অসাধারণ শিক্ষক ইংরেজিতে যে স্মৃতিকথা লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি ১৯৪৭-৫১ শিরোনামে, তারই বাংলা অনুবাদ করেন মোবাশ্বেরা খানম। আমরা সে অনূদিত ভাষ্যকে ভিত্তি করে দেখতে চাইব উপন্যাসের মতো স্বাদু বর্ণনা ও ভাষায় এ জি স্টক কী করে এঁকেছেন হারিয়ে যাওয়া ঢাকার নিপুণ ছবি; যে ঢাকায় সাম্প্রদায়িকতা ছিল আবার সহাবস্থানও ছিল, যে ঢাকায় শ্রেণিবৈষম্য এক প্রধান সত্য আবার মানুষের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন ও রূপকথার গল্প ছিল না।

তাঁর আত্মকথায় তিনি খোলামেলা লিখেছেন যে উগান্ডার প্রভাষক পদে তাঁকে ডাকা হয়নি, ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ে ডাক পেলেন তিনি৷ ইংল্যান্ড থেকে সমুদ্রপথে জাহাজে চেপে নানা পথ হয়ে বোম্বে, তারপর ট্রেনে করে কলকাতায় নামলেন তিনি। তিনি বলেছেন, সচেতনভাবেই আকাশপথে না এসে কলকাতা থেকে ঢাকায় এলেন স্টিমারে চেপে। যে জনপদে তিনি শিক্ষাদান করবেন যেন সেখানকার নিসর্গ ও জনজীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ শিক্ষালাভের জন্যই স্টিমারযাত্রা বেছে নিয়েছিলেন স্টক। তিনি বন্দর নারায়ণগঞ্জে নামার রোমাঞ্চকর বিবরণ দিয়েছেন আর সদ্য দেখা একটি নতুন শহরকে চিত্রিত করেছেন এভাবে—

‘রাস্তার পাশে অপেক্ষারত একটি সাইকেল-রিকশায় মালপত্র চাপিয়ে যাত্রার শেষ পর্যায় শুরু করলাম। পুরোনো ঢাকা শহর তখন নতুন রাজধানীতে পরিণত হয়েছে। প্রচুর চিৎকার করে ও বেল বাজিয়ে বাজিয়ে রিকশাওয়ালা পা চালাতে লাগল। সরু গলির ভেতর দিয়ে পথচারীর ভিড়ের ভেতর দিয়ে সে চলতে লাগল। পথজুড়ে ছোটাছুটি, কেউ কাউকে খুঁজছে, কেউ কোথাও যাচ্ছে। কেউ দাঁড়াচ্ছে, কারও যেন নিজের ছাড়া অন্যের জন্য ব্যয় করার মতো মুহূর্তটি নেই।’

পাঠক, এই বিবরণ পড়লে কি মনে হয় না এটা আজকের ঢাকারই চিত্র! এ জি স্টকের ৭৩ বছর আগের স্মৃতিকথায় এভাবেই সমুজ্জ্বল যেন চিরকালের আলো-আঁধারিময় আমাদের এই ভালোবাসার ঢাকা।

ঢাকায় এ জি স্টকের সার্বক্ষণিক সহায় ছিল তাঁর বেয়ারা ও বাবুর্চি আবদুল এবং ইংরেজি বিভাগের পিয়ন কালিপদ। আবদুলকে নিয়োগ দিয়েছিলেন উপাচার্যের স্ত্রী—‘বেগম হাসান (উপাচার্য ড. মাহমুদ হাসানের স্ত্রী) আমার জন্য, ইংরেজ-বাড়িতে কাজে অভিজ্ঞ একজন বেয়ারা-বাবুর্চি দেখে রেখেছেন।’

আবদুল হকের কার্যপরিধি ছিল স্টকের বাংলোতে রাতের খাবার পরিবেশন করা পর্যন্ত। জানা যাচ্ছে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী আবাসনের বদলে ঢাকারই অন্য কোথাও থাকত। স্টক একাকী বাংলো-রাতে ঢাকাই মশার যে বিবরণ দিয়েছেন, তার সঙ্গেও এখনকার মশককবলিত নগরবাস্তবতার মিল পাওয়া যায় বেশ—
‘মশারির নিচে শুয়ে শুয়ে আমি শব্দের একই কোরাস শুনতাম, যতক্ষণ না শব্দগুলো মিলিয়ে যেত।’


এ জি স্টক তাঁর পূর্ববঙ্গবাসে লব্ধ অভিজ্ঞতার শুরুতেই এখানকার অধিবাসীদের বৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা পান। আবদুল যেন তারই এক প্রতীকপুরুষ—
‘আবদুল হক—আমার বেয়ারা ও বাবুর্চি। সে সত্যিই একটি অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব ছিল। স্বভাবে গুরুগম্ভীর তার পেশায় সেই ছিল শ্রেষ্ঠ, যে কিনা বাছা বাছা ইউরোপিয়ানদের বাড়িতে কাজ করত। সে আমাকে বলেছে যে একসময়ে কলকাতার ইম্পেরিয়াল কেমিক্যালসের ম্যানেজারের বাড়িতে ১৭ জন অধস্তন কর্মচারীর সে ছিল প্রধান পরিচারক। আবার হাইকোর্টের এক কুমার জজের বাড়িতে সে একাই ছিল বাবুর্চি, বেয়ারা, গৃহপরিচারক—সব।...তার সীমিত ইংরেজজ্ঞানে সে আমার চেয়ে বেশি ভালো জেনে ফেলেছে একজন মেমসাহেবের কখন কী কী দরকার আর পা ফেলার আগেই আমি দেখি জিনিসটি তৈরি।’

পুরো বইয়েই আবদুলের নানা কীর্তিগাথা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে৷ এই লেখা লিখতে লিখতেই ফোনে কথা হলো ঢাকা বিশ্ববদ্যালয় পরিবারে এ জি স্টকের ঘনিষ্ঠজন ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বললেন, মিস স্টক মানুষের সঙ্গে সহজে মিশে যেতেন আবার নৈর্ব্যক্তিকভাবে তাকে পর্যবেক্ষণও করতেন।

সেই ‘মিশে যাওয়া ও পর্যবেক্ষণ’-এর ছাপ আমরা দেখতে পাই আবদুলের চিত্রায়ণে।


আগামীকাল ঈদুল আজহা। ঈদ মানে খুশি এবং মানুষে মানুষে মিলন। ঔপনিবেশিক বাস্তবতা আমাদের বিচ্ছিন্নতার উসকানি দেয়। কিন্তু আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব সে বিচ্ছিন্নতাকে দূর করতে চায়। এ জি স্টকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-স্মৃতিকথার অনেক ঐতিহাসিক-সামাজিক ও শিক্ষাপ্রাতিষ্ঠানিক মূল্য আছে। কিন্তু তাঁর বেয়ারা কাম বাবুর্চি আবদুলের সঙ্গে ঢাকায় এসে প্রথম ঈদের যে স্মৃতি বর্ণিত হয়েছে, তার মানবিক মূল্য অতুলনীয়। পাঠক, লেখকের বিবরণেই চলুন পড়ি আজ থেকে পাক্কা ৭৩ বছর আগে এক ভিনদেশি বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকের উদ্যাপিত ঈদ আনন্দ:

‘আমি এসে পৌঁছেছিলাম ১ আগস্টে, রোজা শেষের ১০ দিন আগে। এক চান্দ্রমাসব্যাপী এই রমজান, বছর ঘুরে পেছনে যেতে থাকে সৌর-ক্যালেন্ডারকে অনুসরণ করে এবং এর শেষ হয় ঈদ উৎসব দিয়ে, ইসলামি বছরের সবচেয়ে আনন্দের দিন। সেদিন সব বাড়িতে বিশেষ খাবারের আয়োজন করে রোজা ভাঙা হয় অনেকটা ক্রিসমাসের টার্কি বা প্লাম পুডিংয়ের মতো খাবার দিয়ে। সেদিন সবাই নতুন বা সাদা বা পরিষ্কার কাপড় পরে বাইরে আসে, ঝলমল করতে থাকে—পিলগ্রিমস প্রগ্রেসের উজ্জ্বল একজনের মতো; ঈদ মোবারক বলে একজন আরেকজনকে সম্ভাষণ জানায়। তবে নতুন চাঁদ দেখার খবর কেউ না দেওয়া পর্যন্ত কিন্তু উৎসব শুরু হয় না। যদি মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা থাকে, তবে রোজার সময় বেড়ে ৩০ দিন হয়। যদি তার পরও চাঁদ দেখা না যায়, তবে ধরে নেওয়া হয় সে তার নির্দিষ্ট স্থানেই আছে।
‘এ বছর রাতগুলো ছিল মেঘাচ্ছন্ন।...ঈদ শুরু হলো।

‘আবদুল সকালে নাশতার পর ছুটি নিয়ে গেল, অন্তত আমার তো তা–ই মনে হলো। আমি যেহেতু রান্না করা খাবারের চেয়ে আমার সুবিধামতো স্যান্ডউইচ ও কফি দিয়ে দুপুরের খাবার সারতে পছন্দ করতাম, তাই আমার এতে কোনো অসুবিধাই হলো না এবং আমি একটা বই নিয়ে নিরিবিলি সকালটিতে স্থির হয়ে বসলাম কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে আবদুল ফিরে এল, ছোট কন্যাটিকে সঙ্গে নিয়ে, নিজের বাড়িতে তৈরি অপূর্ব একটি খাবারসহ। জাফরানি রং চালের সঙ্গে মাংস ও অপূর্ব মসলা দিয়ে রাঁধা একটি পদ, মিষ্টি, ফল। ওরা দুজনে উদ্ভাসিত হাসি দিয়ে পরিবেশন করছিল, আমি বসে বসে খাচ্ছিলাম। ওরা আমাকে বাদ দিয়ে ঈদের আনন্দের কথা ভাবতেও পারেনি। সব শোভনতা রক্ষা করে ওদের পরিবারেও আমাকে ডাকতে পারছে না, সুতরাং এর চেয়ে ভালো আর কোনোভাবে কাজটি করা যেত না।’

এ জি স্টক ঢাকা ছেড়ে গেছেন ১৯৫১ সালে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধজাত বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার এসেছেন ইংরেজি বিভাগে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে। তাঁর স্মৃতিকথায় উদ্ভাসিত হয়েছে পূর্ব বাংলার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে শিক্ষক-ছাত্র-কবি-লেখক-সংস্কৃতিকর্মীদের অমলিন মুখচ্ছবি। তবে সবকিছুর বাইরে তাঁর বেয়ারা-বাবুর্চি আবদুলের ‘ঈদ-সারপ্রাইজ’ সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, ‘ওরা আমাকে বাদ দিয়ে ঈদের আনন্দের কথা ভাবতেও পারেনি।’ তাতেই উপলব্ধি হয়, ঈদের মতো প্রাচ্যীয় উৎসব ‘ওরা’ আর ‘আমরা’র ভেদরেখা গুঁড়িয়ে দেয়। বিচ্ছিন্নতার প্রাত্যহিক প্রহরে মিলনের গান গায়৷

৭৩ বছর আগে এই ঢাকা শহরে এ জি স্টক ও আবদুল হকের ঈদ আনন্দের রেশ যেন আজও অনুভব করা যায়। আমরাও সেই রেশ ধরে কাছে-দূরের সবাইকে বলি ‘ঈদ মোবারক’।