ভারত থাইল্যান্ড ভিয়েতনাম থেকে চাল আসতে পারে

চালের ছবিটি প্রতীকী।
চালের ছবিটি প্রতীকী।

গত মার্চ থেকে করোনার সংক্রমণ শুরুর পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও বন্যার মতো দুর্যোগের মুখে পড়েছে দেশ। দুর্যোগকবলিত মানুষের জন্য সরকার চাল দিচ্ছে। এ জন্য সরকারি গুদাম থেকে প্রতি মাসে দুই থেকে তিন লাখ টন চাল বরাদ্দ দিতে হচ্ছে। এতে চালের মজুতও কমে আসছে।

এই পরিস্থিতিতে সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে চাল আমদানি হতে পারে। এ ছাড়া সরকারি পর্যায়ে (জি টু জি) চুক্তির মাধ্যমে এবং বেসরকারি আমদানিকারকদের শুল্ক কমিয়ে দিয়ে চাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হতে পারে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

চাল আমদানির প্রক্রিয়া ঠিক করার পাশাপাশি কোন দেশে থেকে তা আনা হবে, সেটিও ভাবছে সরকার। ভারত থেকে চাল আসার সম্ভাবনা বেশি বলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে। ভারতীয় চালের দাম অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় কম। সেখানে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস উপযোগী সেদ্ধ চাল উৎপাদিত হয়। আর তা দ্রুত আমদানিও করা যাবে। এসব বিবেচনায় সেখান থেকে চাল আনার কথা ভাবা হলেও বিকল্প হিসেবে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের কথাও সরকারের বিবেচনায় আছে বলে জানা গেছে।

এরই মধ্যে ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশে চাল রপ্তানির দুয়ার খুলেছে বলে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। গত ১৮ জুলাই ভারতের সংবাদমাধ্যম ইকোনমিক টাইমস বলেছে, বাংলাদেশে চাল রপ্তানির ব্যাপারে ভারতের চাল রপ্তানিকারক সমিতি থেকে প্রাথমিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হয়েছে।

তবে বড় চালকলের মালিক এবং কৃষি ও খাদ্যবিষয়ক গবেষকেরা মনে করছেন, করোনা ও বন্যার মতো বড় দুটি দুর্যোগের মধ্যে পড়ে যাওয়ায় সরকারি মজুত বাড়ানোটা এখন সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে চালকলমালিকেরা চুক্তি অনুযায়ী চাল না দিলে আমদানির দিকেই যেতে হবে। কিন্তু এর আগে দেশের ভেতর থেকে অন্য কোনো উপায়ে চাল কেনা যায় কি না, সেই চেষ্টাও করা উচিত। কারণ, একবার আমদানি শুরু হয়ে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এর আগে ২০১১–১২ সালে ও ২০১৭–১৮ সালে দেশে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি চাল আমদানি হয়। ফলে এরপরের বছরগুলোতে দেশের বড় অংশের কৃষকদের লোকসান দিতে হয়েছে।

>

বর্তমানে সরকারি গুদামে চালের মজুত ১০ লাখ ৭ হাজার টন
গত বছর তা ছিল ১৫ লাখ ২১ হাজার টন

খাদ্যনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইফপ্রি, বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আখতার আহমেদ মনে করেন, সরকারের উচিত হবে প্রথমে অভ্যন্তরীণ বাজারে দরপত্রের মাধ্যমে চাল সংগ্রহের চেষ্টা করা। তা না করে শুরুতেই আন্তর্জাতিক দরপত্রে চলে গেলে তা প্রাথমিকভাবে হয়তো সরকারি সংগ্রহ বাড়াবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে দেশের কৃষকের জন্য বিপদ তৈরি করতে পারে। কারণ, এর আগেও সংকট মোকাবিলার সময় চাল আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর তা আর নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।

অর্থনীতিবিদেরা আরও মনে করছেন, চাল আমদানি শুরুর আগে দ্রুত একটি জরিপ করে দেখা উচিত, দেশে চালের উৎপাদন কেমন হয়েছে, আদৌ চাল আমদানি করা দরকার কি না। সে ধরনের কোনো মূল্যায়ন ছাড়া আমদানিতে চলে গেলে তা এই করোনা সংকটের সময়ে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা দেশ থেকে চলে যাবে। আর দেশের ভেতর থেকে চাল কিনলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগস্ট পর্যন্ত আমাদের চাল সংগ্রহের সময় আছে। আমরা দেশের চালকলগুলোকে সুযোগ দিতে চাই। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চলার মতো চাল আমাদের আছে। তবে বন্যার কারণে আমনের যদি ক্ষতি হয়, আর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা যদি পূরণ না হয়, তাহলে আমদানি ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকবে না।

সংগ্রহ গত বছরের চেয়ে কম

গত বছরের আগস্টের ৫ তারিখে সরকারি গুদামে বোরো মৌসুম থেকে সংগ্রহের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪ লাখ ১০ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ছিল প্রায় সাড়ে ১১ লাখ টন। এ বছর ওই একই সময়ে সংগ্রহ হয়েছে ৬ লাখ ২০ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ৬ লাখ ২০ হাজার টন। চলতি মাসের মধ্যে সরকারি গুদামে মজুতের জন্য ধান–চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ১৯ লাখ ৫০ হাজার টন।

ধান–চাল সংগ্রহের কারণ হিসেবে খাদ্য অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, দেড় মাস ধরে চালকলমালিকেরা চুক্তি অনুযায়ী চাল দিচ্ছেন না। গুটিকয়েক চালকলমালিক চাল দিলেও তাঁদের বেশির ভাগ সরকারি গুদামে চাল দেওয়া বন্ধ রেখেছেন। কারণ হিসেবে চালকলমালিকেরা ধানের দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন। তাঁরা বলছেন, প্রতি মণ ধানের দাম বাজারে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। এই দামে ধান কিনে চালে পরিণত করলে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম কোনোভাবেই ৪০ টাকার নিচে পড়বে না। আর সরকার প্রতি কেজি চাল ৩৬ টাকা দিতে বলছে।

এ ব্যাপারে দেশের চালকলমালিকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর এবং হাসকিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি আবদু রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, সীমিত আকারে চাল আমদানি করে মজুতের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে ভালো কথা। তবে দেশের বাজারের চেয়ে বেশি দামে আমদানি হলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৪০ বছরের মধ্যে ২০১৯–২০ অর্থবছরে সবচেয়ে কম চাল আমদানি হয়েছে। গত অর্থবছর ও চলতি আগস্টের ৫ তারিখ পর্যন্ত ৪ হাজার ১৮০ টন চাল আমদানি হয়েছে। প্রায় ৮৫ শতাংশ শুল্ক থাকায় বেসরকারি খাতে আমদানি এই অবস্থায় দাঁড়িয়েছে বলে জানা গেছে। এর আগে ২০১৭–১৮ অর্থবছরে শুল্ক কম থাকার সুযোগে প্রায় ৩৯ লাখ টন চাল আমদানি হয়। এরপরের দুই বছর দেশে ধান–চালের দাম কৃষকের উৎপাদন খরচের নিচে চলে যায়। বাড়তি আমদানি করা চাল বাজারে থাকায় টানা দুই বছর ধরে কৃষক লোকসান দিচ্ছিলেন। দুই মাস ধরে ধানের দাম কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় ওই লোকসান থেকে কৃষক কিছুটা লাভ দেখা শুরু করেছেন।

সরকারি খাদ্য বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের হিসাবে, বর্তমানে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে তা ৪২ থেকে ৪৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত এক মাসে মোটা ও সরু চালের দাম ২ থেকে ৪ শতাংশ বেড়েছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) নির্বাহী পরিচালক কে এ এস মুর্শিদ প্রথম আলোকে বলেন, করোনা ও ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাত সইতে না–সইতে বন্যা শুরু হয়ে গেছে। ফলে চালের উৎপাদনের ওপরে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর চালের দাম বেড়ে গেলে যেসব মানুষ আর্থিকভাবে বিপদে আছে, তাদের বিপদ আরও বাড়তে পারে। ফলে আমদানির সুযোগ উন্মুক্ত রাখা উচিত। কিন্তু কত দামে ও কোথা থেকে সেই চাল আসছে এবং কী পরিমাণে আসছে, তা নিয়মিত তদারক করা উচিত। প্রাথমিকভাবে সীমিত পরিসরে চাল এনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা উচিত। আর খেয়াল রাখা উচিত যাতে ২০১৭–১৮ সালের মতো মাত্রাতিরিক্ত চাল আমদানি না হয়।