আমাকে আরও মানবিক হতে হবে

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

কিছু কিছু বিষয়ে আমি খুবই ভিতু। যেমন কুকুর–বিড়াল ভয় পাই। মনে হয় এক্ষুনি কামড় দেবে। আমার এক বন্ধু—সে ১২টা বিড়াল পোষে। দুটি বিড়াল এতই বেয়াদব যে ওর বাসায় আমি গেলেই হলো, আমার পায়ের কাছে এসে ঘষাঘষি শুরু। তাই ওর বাসায় গেলে আমাকে পা তুলে চেয়ারে বসে থাকতে হয়। বন্ধু যতই আমাকে আশ্বস্ত করে পোষা বিড়াল কিছু করবে না, আমি ততই ভয় পাই।

আরেকটি বিষয়ে আমার মন বরাবরই আতঙ্কে আচ্ছন্ন, তা হলো লাশ। কবরস্থানে যাওয়া দূরে থাক, কাছের আত্মীয় মারা গেলেও আমি শেষ দেখা দেখতে যেতাম না। কেন পারতাম না তা আমি নিজেও জানি না।

করোনার জন্য সারা দেশে যখন লকডাউন শুরু হলো, বাবা বলে দিলেন বাসার বাইরে এক পা-ও না। তথাস্তু! বাসায় নিজেকে বন্দী করে রাখলাম। প্রথম সপ্তাহটি প্রায় সারাক্ষণ ইন্টারনেট আর সিনেমা দেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকলাম। কিন্তু আর কত! ভাবলাম নতুন কিছু করি। এই সময়টা নষ্ট হতে দিতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু কী করা যায়? শুনেছি যে জিনিসে সবচেয়ে বেশি ভয় সেটা যদি একবার জয় করা যায় তাহলে আর ভয় বলতে কিছু থাকে না।

মৃত ব্যক্তিকে দেখা বা তার কাছে যাওয়া হলো আমার সবচেয়ে ভয়ের। এই ভয় আমাকে ভাঙতে হবে। কিন্তু চারদিকে করোনাভাইরাসের ছড়াছড়ি। বাইরে বের হওয়া মানা। আর করোনায় মৃতের কাছেও তো যেতে পারব না, যদি আমার করোনা হয়। তাহলে কি আমার ভয়কে জয় করার মিশন বাদ যাবে?

পরের দিন অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল। রিসিভ করতেই বললেন, আপনি তো আমাদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। কয়েকবার রক্তদান করেছেন।
কে বলছেন আপনি?
আমি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে অমুক বলছি।
জি বলেন।

করোনার এই সময়ে যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের আশপাশে কেউ আসতে চাইছে না, ভয় পাচ্ছে। কয়েকটি মৃতের ছেলেমেয়ে পর্যন্ত কেউ আসেনি। তাই আমরা একটি টিম গঠন করেছি। তারা করোনায় মৃতদের দাফন বা দাহ করছে। আপনি চাইলে যোগ দিতে পারেন। মনে মনে ভয় পেলেও কথাগুলো শুনে আনন্দ হচ্ছিল। আমি তো এমন কিছুই করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু যারা এই কাজ করবে তাদের নিরাপত্তা থাকবে তো? জানতে পারলাম, স্বেচ্ছাসেবকদের যথেষ্ট নিরাপত্তা দিয়ে তারা এই কাজ করছে।
আমি রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু বাসায় কী বলব?
মায়ের সামনে গিয়ে অনেকক্ষণ ভাষণ দিলাম—এটি কত মহৎ কাজ, পরে চাইলেও এই সুযোগ পাব না। মা কিছুই বলছেন না। সাহস করে বলে ফেললাম, তাহলে ধরে নেব মৌন সম্মতির লক্ষণ! শুধু বললেন, তোর বাবাকে কিছুই বলার দরকার নেই।

বাবাকে কী বলে মা সামলে রাখবেন জানি না। আমি বেরিয়ে গেলাম। এবার কিছু একটা করতেই হবে। কিন্তু ভয় তখনো পিছু ছাড়েনি। মাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম। কারণ আমি জানি আমার মা সাহসী। আমার নতুন কোনো উদ্যোগকে তিনি কখনো মানা করেননি।

চলে এলাম দাফন ক্যাম্পে।

প্রথম দিন আমাকে ট্রেনিং দেওয়া হলো। বিশেষ যে পোশাক পরে আমরা কাজ করব এটির নাম পিপিই (পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট)। সঙ্গে হেলমেট, মাস্ক, তিনটি হ্যান্ড গ্লাভস, গাম বুট, গগলস, আরও কত কী। এগুলো পরার পর দম নিতে অসুবিধা হচ্ছিল, দরদর করে ঘামছিলাম। মনে হচ্ছিল, লাশ ধরা যতটা চ্যালেঞ্জ হবে তার থেকে এসব পরে থাকা আমার জন্য আরও কষ্টের।

কিন্তু কোনো উপায় নেই। এবার আমাকে সাহসী হতেই হবে।

পরদিন দুপুরে ঢাকা মেডিকেল থেকে খবর এল ষাটোর্ধ্ব একজন নারী মারা গেছেন এবং টেস্ট করে দেখা গেছে তাঁর কোভিড-১৯ পজিটিভ। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও জীবাণুনাশক নিয়ে আমাদের টিম ছুটে গেল ঢাকা মেডিকেলের মর্গে।

আমাদের টিম ছিল ছয়জনের। টিম সদস্যদের একটু বর্ণনা দিই।

জনাব ‘ক’। তিনি টিম লিডার। ব্যবসায়ী, হিউমার আছে। লাশ নিয়ে তাঁর আগ্রহের শেষ নেই। তাঁর এককথা—আমরা লাশকে সর্বোচ্চ সম্মান দেব। কবরস্থানে গিয়ে তিনি জানাজা পড়ান। দাফন শেষে আমাদের সবাইকে নিয়ে আবার প্রার্থনাও করেন।

জনাব ‘খ’। ব্যাংকার। গাড়িতে উঠেই আমাকে বললেন, ‘কি নতুন নাকি? অজ্ঞান কিন্তু হওয়া যাবে না। অজ্ঞান হলে তোমাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হবে। লাশের কাজ ভালোমতো করা হবে না তখন। তাই সাবধান থাকবা।’ তারপর বলতে শুরু করলেন এর আগে কতজন কীভাবে এই কাজে অজ্ঞান হয়েছে।

জনাব ‘গ’। প্রভাষক। সিরিয়াস ধরনের মানুষ। কথা কম বলেন। তাঁকে আমি একবারও হাসতে দেখিনি।

জনাব ‘ঘ’। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আমার জুনিয়র হবে। তার এখানে আসার বেশি দিন হয়নি। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বাবা-মা জানে? বলে যে আমার বাবা নাই, মা-ও নাই। আর কথা বাড়ালাম না। কারণ ঢাকা মেডিকেলের কাছাকাছি চলে এসেছি। তার চেহারায় কোনো ভয় দেখতে পেলাম না।

জনাব ‘ঙ’ হলাম আমি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একটা আতঙ্ক অনুভূতি তখনো আমার বুক বেয়ে পেটের দিকে নেমে যাচ্ছে।

জনাব ‘চ’। আমাদের এই টিমের একমাত্র মহিলা সদস্য। তিনি গৃহিণী। মহিলা লাশের জন্য একজন বা দুজন মহিলা স্বেচ্ছাসেবী দরকার হয়। আমি এখানে এসেছি এ জন্য তিনি বারবার আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন। এসব কিছুই আমার শুনতে ভালো লাগছে না। মাথায় শুধু ঘুরছে কাজটা যেন ঠিকমতো করতে পারি।

ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে গাড়ি থামল। দ্রুত নিরাপত্তা-পোশাক পরে নিলাম। টিম লিডার ডেথ সার্টিফিকেট দেখতে চাইলেন মৃতের আত্মীয়ের কাছে। আত্মীয় বলতে শুধু মেয়ের জামাই এসেছেন।

মর্গের ভেতর আমাদের টিম ঢুকে গেল। আমার হাত-পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। চোখে কম দেখছি। ভালোমতো শুনতেও পাচ্ছি না। ভাবলাম মর্গ থেকে থেকে বের হয়ে যাই। তখনই নাম ধরে লিডার ডাকলেন। বুঝতে পারলাম তিনি তাঁর কাছে যেতে বলছেন। হঠাৎ মনে শক্তি পেলাম। এগিয়ে গেলাম। তিনি মৃতের মাথার দিকে ধরতে ইশারা করছেন। আমি কিছু না ভেবেই ধরে ফেললাম। সবাই মিলে লাশকে নামালাম। অজু করানো হলো, কাফন পরানো হলো। তারপর লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে তুললাম। লাশের গাড়িতে করেই চলে গেলাম আমরা রায়েরবাজার কবরস্থানে। দাফন হলো। শেষ সম্মান জানালাম আমরা। ভয় নিয়ে ভাবাভাবির সময় তখন আর নেই আমার।

কাজ শেষে আমাদের পোশাক খুলে পুড়িয়ে দেওয়া হলো। আমাদের নেওয়ার জন্য ততক্ষণে গাড়ি চলে এসেছে।

আমি গাড়িতে স্থির বসে আছি। সাহসের নতুন একটি অধ্যায় যোগ হলো আমার জীবনে। কিন্তু আমি আনন্দিত হতে পারছিলাম না।

বিশ্বাস করুন, মৃত মহিলার মুখটি বারবার ভেসে উঠছিল। মনে হচ্ছিল আমার অনেক পরিচিত কেউ। মর্গে তাঁর হাসিমাখা মুখ দেখে মনে হচ্ছিল আমরা আসাতে তিনি খুশি হয়েছেন। অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। তাঁর আরেকটু ঘুমের প্রয়োজন। আমরা অযথা তাঁকে কাফন পরাচ্ছিলাম, এসব কিছুর প্রয়োজন নেই তাঁর।

তারপর আমি এক সপ্তাহে আরও ৮টি লাশের দাফনে কাজ করেছি। শ্মশানেও গিয়েছি আমাদের সনাতন দাদাদের সঙ্গে। তাদের টিমে লোক কম হলে আমাকে নেন। আবার আমাদের টিমেও তাঁরা সুযোগ পেলেই কাজ করেন। এত দিনে অবশ্য পুরুষ ও মহিলাদের এবং মুসলিম ও সনাতনের আলাদা টিম হয়ে গেছে।

এসেছিলাম আমি সাহসী হতে। ফিরছি একজন নতুন মানুষ হয়ে। তবে সাহসের স্বাদ আমার উপলব্ধিতে যোগ করল নতুন মাত্রা। মৃত ব্যক্তি আমাকে শেখাল মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। ধনী-গরিব, মুসলিম–হিন্দু সবাই সমান। সবাইকে সমান ভালোবাসতে হবে। এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা যেকেউ যেতে পারি। নিজেকে নিয়ে শুধু না ভেবে আমার আরও মানবিক হতে হবে। কারণ মানুষের পাশে থাকতে পারার অনুভূতিটি অপার্থিব।

*শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়