আঘাত হানার আগে
সামরিক বাহিনীতে অসম্ভব অসন্তোষ থাকায় ঢাকায় অবস্থানরত কূটনীতিক মহলে সেনাবাহিনীর মধ্য থেকে সম্ভাব্য অভ্যুত্থান নিয়ে বেশ জোরালো গুঞ্জন উঠেছিল। তবে ভারতীয় হাইকমিশনের মতো আর কোনো কূটনীতিক মিশন একটি সম্ভাব্য চক্রান্ত নিয়ে এতে বেশি চোখকান খোলা রাখেনি। এই চক্রান্তের বিষয়ে ক্রমাগত প্রতিবেদন পেতে থাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এত উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন যে তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র–এর প্রধান আর এন কাওকে ঢাকায় পাঠান শেখ মুজিবুর রহমানকে সতর্ক করার জন্য। ইন্দিরা গান্ধীর জীবনীপ্রণেতা পুপুল জয়কর পরে কাওয়ের যে সাক্ষাৎকার টেপরেকর্ডে ধারণ করেছিলেন, তাতে বলেছিলেন, ‘আমরা (বঙ্গভবনের) বাগানে হাঁটছিলাম। আমি মুজিবকে জানালাম, আমাদের কাছে তথ্য আছে যে তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত চলছে। কিন্তু তিনি তখন বেশ উৎফুল্ল অবস্থায় কাটাচ্ছেন। “আমার কিছু হবে না”, তিনি বললেন, “ওরা সবাই আমার লোক।” আমি তাঁকে আমাদের কাছে থাকা চক্রান্তের সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়ার পরও তাঁর তেমন কোনো ভাবান্তর হয়নি।’ কাওয়ের কাছে এমন প্রতিবেদনও পৌঁছেছিল যে দেশের বাইরের শক্তি এই চক্রান্তের আসল পরিকল্পনাকারী।
১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে কাও আরেকটি প্রতিবেদন হাতে পান। তাতে বলা হয় যে মুজিবের বিরুদ্ধে চক্রান্তে আর্টিলারি বা গোলন্দাজ বাহিনীর অংশও জড়িত হয়েছে। সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার মেজর খন্দকার রশিদের অধীনে ৬০০ সেনা ও ১৮টি হাউইৎজার ছিল। অন্যদিকে বেঙ্গল ল্যান্সারের সেকেন্ড ইন কমান্ড কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের নিয়ন্ত্রণে ছিল সমস্ত ট্যাংক ও ৮০০ সৈন্য। মুজিব ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের—যাঁরা তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীও বটে—ওপর আঘাত হানার জন্য এই দুজনের সমন্বিত সৈন্য ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল যথেষ্ট। ঘটনার আকস্মিকতা অর্জন করতে পারলে এতে সফল হওয়ার সম্ভাবনাও ব্যাপক।
তারপরও ফারুক ও রশিদের প্রয়োজন ছিল নামকাওয়াস্তে হলেও এই ষড়যন্ত্রের একজন নেতা খুঁজে বের করার, যিনি জাতীয়ভাবে পরিচিত। এ রকম একজন নেতা ছাড়া এই অভিযান প্রাথমিকভাবে সফল হলেও যদি দেশের ভেতরে জনগণ এবং বাইরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না পায়, তাহলে পুরোটাই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতো। একাধিক কারণে এই নেতা হিসেবে জেনারেল জিয়া ছিলেন তাঁদের স্বাভাবিক পছন্দ। ১৯৭১ সালের মার্চে চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে জিয়া ঘরে ঘরে একটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর জেড ফোর্সের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর এই প্রত্যাশা জন্মেছিল যে শেখ মুজিব তাঁকে চিফ অব আর্মি স্টাফ করবেন। কিন্তু তাঁকে ডিঙিয়ে মেজর সফিউল্লাহকে এই পদে নিযুক্ত করা হয়। তিনি জিয়ার ব্যাচমেট হলেও (সেনাবাহিনীতে) তাঁর কনিষ্ঠ ছিলেন। জিয়ার অতি উচ্চাভিলাষের জন্য শেখ মুজিব তাঁকে অবিশ্বাস করতেন। এটাই জিয়ার জন্য প্রকারান্তরে আশীর্বাদ বয়ে আনে। সেনাবাহিনীর কোনো ঘটনার জন্য কেউ তাঁকে দায়ী করতে পারত না। ফারুক ও রশিদের মনে কোনো সন্দেহই ছিল না যে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে জিয়ার যথেষ্ট আক্রোশ ছিল, তাই তিনি এই চক্রান্তের নেতৃত্ব দিতে সম্মত হবেন।
২০ মার্চ সন্ধ্যায় ফারুক জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পান। ফারুককে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হয়েছিল। তাঁকে এই সাক্ষাতের কারণ দেখাতে হয়েছিল। ফারুকের ভাষ্যমতে, ‘আসলে কথাবার্তার একপর্যায়ে আমরা বলাবলি করছিলাম যে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো কিছু ঠিকমতো চলছে না। দেশে একটা পরিবর্তন দরকার...’
‘ঠিক, ঠিক, চলো আমরা বাইরে যাই। লনে গিয়ে কথা বলি।’ বললেন জিয়া।
লনে আসার পর ফারুক সরাসরি আসল কথায় এলেন। তিনি বললেন, ‘আমরা পেশাদার সৈনিক। আমরা দেশের সেবা করি, কোনো ব্যক্তির নয়। সেনাবাহিনী, বেসামরিক প্রশাসন, সরকার—সব নর্দমায় ডুবতে বসেছে। আমাদের এটা পরিবর্তন করতে হবে। আমরা কনিষ্ঠ সেনা কর্মকর্তারা একটা পরিকল্পনা করেছি। আমরা আপনার সমর্থন চাই, আপনার নেতৃত্ব চাই।’
‘আমি দুঃখিত, আমি এ রকম কোনো কিছুতে জড়িত হতে চাই না,’ জিয়া উত্তর দেন। ‘তোমরা যদি কিছু করতে চাও, তাহলে সেটা জুনিয়র অফিসারদেরই করতে হবে।’
তাঁদের এই কথোপকথনের বিষয়টি জিয়া রাষ্ট্রপতি বা আর্মি চিফ অব স্টাফকে অবহিত করেননি। তবে তাঁর এডিসিকে বলে দিয়েছিলেন, তিনি আর ফারুকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে চান না। আবার যদি তিনি সাক্ষাৎ চান, তাহলে যেন সেটা প্রত্যাখ্যান করা হয়।
এটা কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে জিয়া সতর্ক ছিলেন এবং কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য এটা ছিল হতাশাজনক। তবে রশিদের বিকল্প পরিকল্পনা ছিল। সেটি হলো খন্দকার মোশতাক আহমদের দ্বারস্থ হওয়া। তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে বাকশাল বাস্তবায়িত হওয়ার এবং আগস্ট মাসের মাঝামাঝি শাসনব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের কথা ছিল। এর আগেই শেখ মুজিবকে হত্যা এবং তাঁর সরকারকে উচ্ছেদ করা চক্রান্তকারীদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছিল। ৬০ জন জেলা গভর্নর ও বাকশালের সম্পাদকেরা যদি একবার দায়িত্ব নিয়ে ফেলেন, তাহলে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ, রক্ষীবাহিনী ও সেনাবাহিনীর অনুবিভাগগুলো পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। এসব গভর্নর আর সম্পাদকদের আবার বাছাই করেছিলেন স্বয়ং মুজিব এবং তাঁর কিচেন ক্যাবিনেট বা ঘরোয়া মন্ত্রিসভা। ষড়যন্ত্রকারীদের অবশ্য এটা জানার কোনো উপায় ছিল না যে এই বাহিনীগুলো নিষ্ক্রিয় থেকে অভ্যুত্থানের ফল মেনে নেবে, নাকি অভ্যুত্থানকারীরা ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার আগেই নিজেদের স্বার্থে তাঁদের দমন করতে এগিয়ে যাবে।
মোশতাককে সঙ্গে পাওয়ার বিষয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা এতটাই নিশ্চিত ছিল যে অভ্যুত্থান ঘটানোর মাত্র অল্প কয়েক দিন আগে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। খন্দকার মোশতাক এবং খন্দকার রশিদ একই পারিবারিক উপাধিধারী ছিলেন। খন্দকার মানে পীরের বংশধর। তাঁরা কুমিল্লার কাছাকাছি দুটি গ্রাম থেকে এসেছিলেন। একেবারে শেষ মুহূর্তে মোশতাককে বিষয়টি অবহিত করে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বলার মধ্যে একটা সুবিধা ছিল। পরিকল্পনা প্রণয়নের পর্যায়ে ষড়যন্ত্রকারীর সংখ্যা যত কম হয়, ততই তা ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। ঢাকায় সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও এ বিষয়ে একেবারে অন্ধকারে ছিল।
তবে ইন্দিরা গান্ধীর কোনোই সন্দেহ ছিল না যে ষড়যন্ত্রকারীরা শেখ মুজিবকে উৎখাতের পরিকল্পনায় ব্যস্ত রয়েছে। শুধু জানতে বাকি ছিল, ঠিক কারা এটা করছে এবং কখন তারা আঘাত হানবে। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতে তিনি ও শেখ মুজিব জ্যামাইকার কিংস্টনে যান। সেখানে ইন্দিরা মুজিবকে বলেন, ‘বাংলাদেশে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।’ শেখ মুজিবের জবাব ছিল, ‘আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে?’ জবাব ছিল, ‘আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে দয়া করে আপনি খুব সাবধানে থাকবেন। আমার মনে হচ্ছে সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।’ প্রত্যুত্তরে মুজিব বললেন, ‘না, না, ওরা সবাই আমার সন্তান।’
কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করার জন্য আঘাত করবে, এ রকম কোনো কথা শুনলে শেখ মুজিব তৎক্ষণাৎ তা প্রত্যাখ্যান করতেন। তবে শেষের দিকে দেরিতে হলেও তাঁর ভেতর একটু প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করেছিল। দুই সপ্তাহ পর ১৪ মে বুধবার তাঁর সচিব আবদুর রহিম নিজের ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘গতকাল অফিসে এসেই বঙ্গবন্ধু বেশ রাগতভাবে তাঁর ব্যক্তিগত ও বঙ্গভবনের সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করতে হবে।’ এরপর তিনি তাঁর নিজস্ব মন্তব্য হিসেবে লিখেছেন, ‘আসলে নিরাপত্তাব্যবস্থায় অনেকগুলো ত্রুটি–বিচ্যুতি রয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো ধানমন্ডির বর্তমান বাসভবনে সর্বাত্মক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব ব্যাপার। আর তিনিও বঙ্গভবন বা গণভবনে গিয়ে থাকতে চান না।’
পরের কয়েক দিন মুজিবের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার ও উন্নত করার জন্য কয়েক দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু কাজটি করার জন্য জরুরি তাগিদ অনুভূত হয়নি।
দুই ভায়রা ভাই ফারুক ও রশিদ একমত হয়েছিলেন যে এই অভ্যুত্থান ঘটানোর উপযুক্ত সময় হলো ১৫ আগস্টের ভোর। তাঁদের অধীনে থাকা অস্ত্রশস্ত্র ও গোলন্দাজ বাহিনী প্রতি দুই সপ্তাহে একবার রাতে যৌথ মহড়া দিতে শুরু করেছিল। মহড়াটি হতো ঢাকার উত্তরে বালুরঘাটে একটি ফাঁকা জায়গায়, এখন যেখানে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। তাঁদের চূড়ান্ত করণীয় ছিল নির্ধারিত রাতের শেষে এই মহড়াটিকে রাজধানীর সরকারি মহলের ওপর বাস্তব অভিযানে রূপান্তরিত করা।
মোশতাকের সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠকের সময়ও ঘনিয়ে এল। ২ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টায় রশিদ মোশতাকের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। তাঁকে সতর্ক থাকতে হয়েছিল। সাধারণ পোশাকে তিনি একটি মোটরসাইকেল ক্রয়ের পারমিট চাওয়ার লিখিত দরখাস্ত নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ছুতো তৈরি করেন। তাঁদের বৈঠক চলেছিল প্রায় দুই ঘণ্টা। রশিদকে বুঝতে হয়েছিল যে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মোশতাক কী মনে করেন। যখন তিনি এটা নিশ্চিত হলেন যে মোশতাক আর ‘শেখ মুজিবের নেতৃত্বে কোনো অগ্রগতি’র আশা করেন না, তখন রশিদ সাহস সঞ্চয় করে তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসলেন, ‘এই অবস্থায় যদি কেউ জোর করে শেখ মুজিবকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে কি তা যুক্তিযুক্ত হবে?’ মোশতাকের জবাব ছিল, ‘দ্যাখো, দেশের স্বার্থে সম্ভবত এটি একটি ভালো কাজ হবে।’
মোশতাক যখন ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্যের প্রতি নীতিগত সমর্থন দিতে ঝুঁকলেন, তখন তাঁর সঙ্গে ১১, ১৩ ও ১৪ আগস্ট রশিদের আরও কয়েক দফা বৈঠক হয়। রশিদের ভাষ্য অনুসারে, সেখানে তাঁদের আলোচ্য ছিল কীভাবে শেখ মুজিবকে ‘ক্ষমতা থেকে জোরপূর্বক অপসারণ করা হবে এবং এটি করতে গিয়ে শেখ মুজিবকে হত্যাও করতে হতে পারে।’
অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রকৃত তারিখ মোশতাককে জানানো হয়নি। সে কারণে ষড়যন্ত্রকারীদের এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হয়েছিল যে শিগগির মোশতাক ঢাকার বাইরে কোথাও যাচ্ছেন না। অভ্যুত্থানের পর সরকার গঠনের জন্য তাঁর উপস্থিতি আবশ্যক ছিল।
অনুবাদ: আসজাদুল কিবরিয়া
সূত্র: শেখ মুজিব: ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ট্র্যাজেডি, এস এ করিম, ইউপিএল, ২০২০