চলে গেলেন এবিএম মূসা

ছবি: খালেদ সরকার
ছবি: খালেদ সরকার

প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবিএম মূসা আর নেই। আজ বুধবার বেলা সোয়া একটার দিকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহে...রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, আজ বেলা একটা ১৫ মিনিটে এবিএম মূসার কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসব্যবস্থা (লাইফ সাপোর্ট) খুলে নেওয়া হয়। ৭ এপ্রিল দিবাগত রাত আড়াইটা থেকে তাঁকে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসব্যবস্থার মধ্যে রাখা হয়। অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় আজ তাঁর কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসব্যবস্থা খুলে নেওয়া হয়।
ল্যাবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ৮৩ বছর পেরোনো এবিএম মূসা অনেক দিন ধরেই শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। সর্বশেষ ২৯ মার্চ তাঁকে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
বেলা আড়াইটায় ল্যাবএইড থেকে এবিএম মূসার মৃতদেহ তাঁর মোহাম্মদপুরের বাসায় নেওয়া হয়। সেখানে সাংবাদিক, মরহুমের আত্মীয়স্বজন ও সাধারণ মানুষের ভিড় জমতে থাকে। এবিএম মূসার ছেলে নাসিম মূসা উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, মৃত্যুর পর তাঁকে (মূসাকে) নিয়ে যেন কেউ ব্যবসা না করে এই অনুরোধ তিনি করে গেছেন।

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বরেণ্য সাংবাদিক এবিএম মূসার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে এক শোকবার্তায় বলেন, ‘সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এবিএম মূসার অমূল্য অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর মৃত্যু দেশের সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।’

পৃথক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে ও তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেন, দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে এবিএম মূসা বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে ছিলেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শোকবার্তায় বলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটকালে তাঁর মতো একজন সত্, নিষ্ঠাবান, নিরপেক্ষ, নির্লোভ ও নির্ভীক সাংবাদিকের খুবই প্রয়োজন।

এবিএম মূসা তিন মেয়ে মরিয়ম সুলতানা, পারভীন সুলতানা ও শারমীন মূসা এবং এক ছেলে নাসিম মূসাসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

আজ বাদ মাগরিব ইকবাল রোড মাঠে মরহুমের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর মরদেহ ল্যাবএইড হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মরদেহ কাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে নেওয়া হবে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজার পর মরদেহ ফেনীতে নেওয়া হবে। ফেনীর মিজান ময়দানে বাদ মাগরিব তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর তাঁর মরদেহ গ্রামের বাড়ি ফুলগাজীর কুতুবপুরে নেওয়া হবে এবং পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে। 

সংক্ষিপ্ত জীবনী

জাতীয় প্রেসক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ক্লাবের আজীবন সদস্য এবিএম মূসা ১৯৩১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর নানার বাড়ি ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার ধর্মপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছয় দশকের বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫০ সালে দৈনিক ইনসাফ-এ তাঁর সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়। ওই বছর তিনি ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার-এ যোগ দেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রতিবেদক, ক্রীড়া প্রতিবেদক ও বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় অবজারভার বন্ধ করে দেওয়া হলে এবিএম মূসা সংবাদ-এ যোগ দেন। অবজারভার চালু হলে ১৯৫৪ সালে আবার ফিরে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিবিসি, সানডে টাইমস প্রভৃতি পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবে রণাঙ্গন থেকে সংবাদ পাঠাতেন। স্বাধীনতার পর এবিএম মূসা বিটিভির মহাব্যবস্থাপক ও মর্নিং নিউজ-এর সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

মূসা ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে জাতিসংঘের পরিবেশ কার্যক্রমের (এসকাপ) এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার আঞ্চলিক পরিচালক পদে যোগ দেন। দেশে ফিরে ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এবং ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার মহাব্যবস্থাপক ও প্রধান সম্পাদক ছিলেন। ২০০৪ সালে তিনি কিছুদিন দৈনিক যুগান্তর-এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

এবিএম মূসা জাতীয় প্রেসক্লাবের চারবার সভাপতি ও তিনবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। একুশে পদকসহ দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এই সাংবাদিক।

শোক

সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবিএম মূসার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও সাংবাদিক নেতাদের পাশাপাশি দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী শোকবার্তায় বলেন, এবিএম মূসার মতো সাহসী ও সত্ মানুষ সাংবাদিকতা জগতে বিরল।

শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে বার্তা পাঠিয়েছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ। 

জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ এক বিবৃতিতে বলেন, এবিএম মূসার নিষ্ঠা, সাধনা, আদর্শ ও পেশার প্রতি অঙ্গীকার তরুণ সাংবাদিকদের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন বলেছে, গণতন্ত্র, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাক্স্বাধীনতা যখনই সংকটের মুখে পড়েছে, তখনই এবিএম মূসা সোচ্চার ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। শোক জানিয়েছে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, অনলাইন প্রেস ইউনিটি।

শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশ জালালী পার্টি, জাকের পার্টি, নতুনধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, গণসংহতি আন্দোলন, আমরা মুক্তিযুদ্ধের সন্তানসহ আরও অনেক সংগঠন।