জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশে: প্রধানমন্ত্রী

শেখ হাসিনা
শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই। অথচ এ দেশটিই মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিশ্ববাসীকে আরও সোচ্চার হতে হবে।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও সাত দিনব্যাপী পরিবেশ মেলা এবং তিন মাসব্যাপী জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা ২০১৪-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। খবর বাসসের।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। স্বাগত বক্তব্য দেন মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী।

হাজারীবাগ ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরের কাজ শুরু করা হয়েছে, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চামড়া ব্যবসায়ীদের দ্রুত সেখানে তাঁদের কারখানা স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘যারা কারখানা স্থানান্তর করবে না, তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ট্যানারি স্থানান্তরের আগে থেকেই সেখানে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) স্থাপনের কাজ শুরু করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, তাঁর সরকার শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ইটিপি কার্যক্রম অনলাইনে মনিটর করার পরিকল্পনা নিয়েছে। কারণ, লক্ষ করা গেছে, অনেক প্রতিষ্ঠানই ইটিপি থাকা সত্ত্বেও তা চালুর পরিবর্তে বন্ধ করে রাখে। সরকারি লোকজন পরীক্ষায় গেলেই শুধু তা চালু করা হয়। তিনি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এ ব্যাপারে সরকার এখন বেশ সজাগ। কোনো রকম অনিয়ম প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৮১২টি শিল্প কারখানায় ইটিপি স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। ২০১৮ সালের মধ্যে কলকারখানাগুলোতে শতভাগ ইটিপি চালুর পরিকল্পনা তাঁর সরকার হাতে নিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বায়ুদূষণের মাত্রা কমানোর লক্ষ্যে তাঁর সরকার এর মধ্যে ২ হাজার ১৪১টি ইটভাটাকে আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটায় রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব ইটভাটাকেই এই আধুনিক প্রযুক্তি নিতে হবে।
বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে তাঁর সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নদীর উভয় পাড়ে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে নদীর গভীরতা বাড়বে এবং বেশি জল ধরে রাখা সম্ভব হবে।
রাজধানী ঢাকার চারপাশে যে পাঁচটি নদী আছে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সেসব নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতেও তাঁর সরকারের উদ্যোগের কথা জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, রাজধানীতে এখন যেকোনো স্থাপনা গড়তে হলে জলাধার রাখতে হবে। তা না হলে কোনো স্থাপনা গড়তে দেওয়া হবে না। কারণ জলাধার না থাকলে পানি পাওয়া যাবে না। এ চিন্তা থেকেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এতে অবশ্য অনেকেই আমার ওপর নাখোশ। তাদের আবার পত্রিকাও আছে, সেই পত্রিকায় আমার সরকারের বিরুদ্ধে অনেক লেখালেখিও হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী বসুন্ধরা শপিং সেন্টারে আগুন লাগার কথা উল্লেখ করে বলেন, ওই আগুন নেভাতে সোনারগাঁও হোটেলের সুইমিংপুল থেকে পানি আনতে হয়েছিল। অথচ পান্থপথেই একটি খাল ছিল। সেটির ওপর বক্স কালর্ভাট না করে যদি পরিকল্পিতভাবে তা রক্ষা কর তার দুধারে স্থাপনা গড়ে তোলা হতো, তাহলে বসুন্ধরার আগুন নেভাতে আর পানির সমস্যা হতো না।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি এ বছরের পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘রেইজ ইয়র ভয়েস, নট দ্য সি লেভেল’ অর্থাত্ ‘হতে হবে সোচ্চার, সাগরের উচ্চতা বাড়াব না আর’—যা সারা বিশ্ব বিশেষ করে আমাদের মতো উপকূলবর্তী দেশের জন্য অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ।’ তিনি বলেন, ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জের রিপোর্ট অনুসারে একদিকে সমুদ্রের পানির স্ফীতি ঘটছে, অন্যদিকে গত ২০ বছরে মেরু অঞ্চলসহ বিভিন্ন হিমবাহের বরফ স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক হার গলছে। এর ফলে ছোট দ্বীপরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বহু দেশের উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল সমুদ্রের গর্ভে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, এ ছাড়া শিল্পোন্নত দেশগুলো শত বছর ধরে লাখ লাখ কোটি টন কার্বন বায়ুমণ্ডলে ছেড়েছে। ফলে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়েছে। বাংলাদেশসহ সমুদ্র উপকূলীয় দেশগুলো ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী গত পাঁচ বছরে পরিবেশ রক্ষায় তাঁর সরকারের ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মসূচির বর্ণনা দিয়ে বলেন, পরিবেশ আদালত আইনসহ নতুন আইন প্রণীত হয়েছে। পুরোনো আইনগুলো সংশোধন করে যুগোপযোগী এবং আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, তাঁর সরকার ২০০৯ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের জনবল ২৬৭ থেকে ৭২০-এ উন্নীত এবং ২১টি জেলায় অফিস স্থাপন করেছে। দেশের ৬৪টি জেলাতেই পরিবেশ অধিদপ্তরের অফিস সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তাঁর সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার জলবায়ু পরিবর্তন কর্মকৌশল ও কর্মপরিকল্পনা ২০০৯ প্রণয়ন করেছে। জলবায়ু ট্রাস্ট আইন ২০১০ পাস এবং এর আওতায় ২০১৩ সালে বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট নামে সংবিধিবদ্ধ সংস্থা গঠন করা করেছে। তিনি বলেন, বিদেশি অর্থের ওপর নির্ভর না করে তাঁর সরকার নিজেদের অর্থেই ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ডে বরাদ্দ দিয়েছে। এ ফান্ড থেকে ২৭০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে ২০১০ সালে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রিসাইলিয়েন্স ফান্ড (বিসিসিআরএফ) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তিনি বলেন, সাতটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে এ পর্যন্ত ১৮৯ দশমিক ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওয়া গেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৫তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে আমি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য একটি আন্তর্জাতিক “গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড” গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘আশার কথা, গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড গঠিত হয়েছে। আশা করছি, শিগগিরই এই সংস্থাটি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় অর্থায়ন ও কার্যক্রম গ্রহণ করবে।’ বাংলাদেশ এই গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড বোর্ডের বিকল্প সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।
পরিবেশ, প্রতিবেশ, বন সংরক্ষণ ও উন্নয়নে তাঁর সরকার সকল বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, তাঁর সরকার পাহাড়, নদী, জলাশয়, জলাভূমি, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিজ্জ রক্ষায়ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য উত্পাদন, আমদানি, মজুদ ও পরিবহনে আইনের প্রয়োগ জোরদার করা হয়েছে।
‘বেঁচে থাকার উপকরণ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্সা ও নির্মল পরিবেশ আমরা বৃক্ষ থেকেই পাই’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ২০১৪-এর এবারের প্রতিপাদ্য ‘অধিক বৃক্ষ অধিক সমৃদ্ধি’ অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে। তিনি বলেন, তাঁর সরকার বন সংরক্ষণ, টেকসই বন ব্যবস্থাপনা এবং বনের কার্বন মজুদ বৃদ্ধির জন্য রিডিউসিং এমিশন ফ্রম ডিফরেস্টেশন অ্যান্ড ফরেস্ট ডিগ্রেডেশন (আরইডিডি) কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও কার্বন মজুদ বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কার্বন বিক্রয় ও পেমেন্ট ফর ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস থেকে প্রাপ্ত আয় আরইডিডির সঙ্গে সম্পৃক্ত জনগণ ভোগ করবে।
যাঁরা পরিবেশ পদক ২০১৪, বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার ২০১৩, বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন পুরস্কার ২০১৪ অর্জন করেছেন এবং যাঁরা সামাজিক বনায়নে লভ্যাংশের চেকের জন্য মনোনীত হয়েছেন, অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের হাতে পুরস্কারের ক্রেস্ট ও চেক তুলে দেন। পরিবেশ রক্ষায় বনায়ন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ায় তিনি তাঁদের অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. খবীর উদ্দীন, টিভি ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেত ও রুরাল সার্ভিস ফাউন্ডেশন ২০১৪ সালের জাতীয় পরিবেশ পদক পায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. মোস্তফা ফিরোজ, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মো. বন্দে আলী খান, নাটোরের নলডাঙ্গার মো. জুয়েল রানা ও নটর ডেম ন্যাচার স্টাডি ক্লাব বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন ২০১৪ পুরস্কার পায়।