মো. আনোয়ারুল আজিম

স্কেচ: এ এফ এম মনিরুজ্জামান
স্কেচ: এ এফ এম মনিরুজ্জামান

একাত্তরের ৫ মে একদল পাকিস্তানি সেনা নাটোরের নর্থ বেঙ্গল (গোপালপুর) সুগার মিলের পুকুর পাড়ে লেফটেন্যান্ট মো. আনোয়ারুল আজিমসহ শতাধিক বাঙালিকে দাঁড় করায়। সেনাদের নেতৃত্বে ছিল এক সুবেদার মেজর। পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে মো. আনোয়ারুল আজিম জামার বোতাম খুলে বুক পেতে সুবেদার মেজরকে বলেন, ‘আমাকে হত্যা না করে কাউকে হত্যা করা যাবে না।’ পাকিস্তানি সেনারা পুকুরের পাড়ে দাঁড় করে রাখা সবার ওপর একসঙ্গে ব্রাশফায়ার করে। গুলিতে তিনিসহ বেশির ভাগ শহীদ হন। মো. আনোয়ারুল আজিম ছিলেন ওই মিলের প্রধান প্রশাসক।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর স্ত্রী শামসুন্নাহার আজিমের লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের যে পুকুর পাড়ে ১৯৭১ সালের ৫ মে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী আত্মাহুতি দিলেন, সেই পুকুরের বর্তমান নাম “শহীদ সাগর” এবং এই পুকুর পাড়েই আমার সমস্ত স্মৃতি থমকে দাঁড়িয়ে আছে। এখানেই শতাধিক শহীদের মধ্যে রয়েছেন আমার স্বামী লেফটেন্যান্ট মো. আনোয়ারুল আজিম।...
‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উদ্যত বন্দুকের সামনে তিনি অকুতোভয়ে জামার বোতাম খুলে বুক পেতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেছিলেন, “আমাকে গুলি না করে আমার একটা লোককেও গুলি করা যাবে না।”...
‘সকালে আজিম সাহেব মিলের অন্যান্য কর্মচারীসহ পাশের গ্রামে গিয়েছিলেন।...আমার স্বামী মিল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মিলিটারি মিলে লুটপাট শুরু করে দেয়।...আজিম সাহেব গ্রাম থেকে ফিরে আসার পর একজন মিলিটারি তাঁর অফিসে গিয়ে গেস্টহাউসে অফিসার সালাম জানিয়েছে বলে তাঁকে ডেকে নিয়ে যায়। কিন্তু গেস্টহাউসে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে তাঁকে পথের পাশে পুকুর পাড়ে নিয়ে যায়।...নর্থবেঙ্গল সুগার মিল ছিল নাটোর জোনের মধ্যে এবং সেখানকার ইনচার্জ মেজর সেরওয়ানী আমরা যে গ্রামে পালিয়ে ছিলাম সেখান থেকে আমার স্বামী ও মিলের কেমিস্ট মি. শওকতকে ধরে নিয়ে মিল চালু করার নির্দেশ দেয়। মিলের লোকের নিরাপত্তার জন্য মেজর কোরআন ছুঁয়ে শপথ করে যদি মিলে কোনো লোকের ক্ষতি হয় তাহলে সে তার ব্যাজ খুলে ফেলবে।’ (শামসুন্নাহার আজিমের রচনা। স্মৃতি ১৯৭১, প্রথম খণ্ড (প্রথম প্রকাশ ১৯৮৮), সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।
মো. আনোয়ারুল আজিমের জন্ম ১৯৩১ সালের ১৩ ডিসেম্বর। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নওগাঁ জেলার রানীনগর গ্রামে। বাবা খান সাহেব মো. আফজাল। তিনি ১৯৪৭ সালে দিনাজপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাটট্রিক, ১৯৫১ সালে দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে আইএ ও ১৯৫৩ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। বিএ পড়ার সময় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেওয়ার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তিনি আত্মগোপন করেন।

ফুটবল ও টেনিস খেলায় পারদর্শী শহীদ আজিম গায়ক, বক্তা ও ন্যাট্যশিল্পী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স বিষয়ে এমএ ও আইন বিষয়ে এলএলবি ডিগ্রি নেওয়ার আগে ১৯৬৫ সালে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার ম্যানেজমেন্ট’ বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।
রাজশাহী কলেজে পড়াশোনার সময় তিনি রাজশাহী কলেজে ‘নওগাঁ সমিতি’ ও দিনাজপুরে ‘শক্তি পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ফজলুল হক হল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন। চাকরিকালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনারারি লেফটেন্যান্ট পদে বহাল ছিলেন। তখন পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র কয়েকজন এ ধরনের সম্মানজনক পদবির অধিকারী ছিলেন।
স্বাধীনতার পর তাঁর স্মরণে গোপালপুর রেলস্টেশন ‘আজিমনগর’ নামকরণ করা হয়। স্টেশনটি এখন এ নামেই পরিচিত।
সূত্র: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (তৃতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত সরণিকা (১৯৯৪)।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান